আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যাঁরা না বুঝে, না জেনে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভেজাল ও নকল পণ্য ব্যবহার করেন। অনেক সময় প্রিয়জনকে উপহার হিসেবেও দেন ভেজাল পণ্য। গবেষণায় দেখা গেছে যে নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে বানানো এসব পণ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণ টক্সিন। টক্সিন মানেই কিন্তু বিষ। সুতরাং আপনি এক অর্থে বিষ কিনছেন, ব্যবহার করছেন এবং অন্যকে উপহার হিসেবেও দিচ্ছেন, যার প্রভাবে শুধু আপনার ত্বকই নয়, শরীরের অন্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব পণ্যের মধ্যে থাকে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত স্কিন, হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্ট ও প্রসাধনী।
রং ফরসাকারী ক্রিম
রং ফরসাকারী ক্রিমে থাকে স্টেরয়েড, মার্কারি ও হাইড্রোকুইনোন। দীর্ঘদিন স্টেরয়েডযুক্ত পণ্য ব্যবহারে দেখা দেয় স্টেরয়েড ইনডিউসড একনি অর্থাৎ ব্রন। এতে ত্বক পাতলা ও সংবেদনশীল হয়ে যায়। অনেক সময় ত্বকে দেখা দেয় অবাঞ্ছিত লোম। মার্কারি কিন্তু পেইন্ট স্ট্রিপার হিসেবে কাজ করে। আমরা সাধারণত দেয়ালের রং দূর করার জন্য যে পেইন্ট রিমুভার ব্যবহার করি, সেখানে থাকে মার্কারি। সে ক্ষেত্রে আমরা যখন মার্কারিযুক্ত রং ফরসাকারী ক্রিম ব্যবহার করি, তা আমাদের ত্বকের উপরিভাগের স্তরটাকে ধ্বংস করে দেয় এবং রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে কিডনি ও লিভারের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোও ধ্বংস করতে থাকে। এর ফলে দেখা দেয় রেনাল ফেইলিওর। মার্কারিকে কার্সিনোজেনিক উপাদানও বলা হয়, যা ব্যবহারে ত্বকে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।
হাইড্রোকুনোন একটি ব্লিচিং এজেন্ট। ত্বকে কোনো ধরনের পিগমেন্টরি ডিজঅর্ডার হলে আমরা চিকিৎসকেরা একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় হাইড্রোকুইনোন ব্যবহার করতে বলি। কিন্তু সব রং ফরসাকারী ক্রিমে অধিক মাত্রায় হাইড্রোকুইনোন থাকে; যা ব্যবহারে আনইভেন স্কিন টোন, মিসম্যাচ স্কিন ও অক্রোনোসিস নামে একধরনের রোগ দেখা দেয়।
আমরা যে হ্যান্ডওয়াশ, ক্লিনজার, ডিটারজেন্ট ব্যবহার করি, সেগুলোয় অনেক সময় ট্রাইক্লোসান থাকে। কেনার আগে দেখতে হবে যে এগুলো ট্রাইক্লোসানমুক্ত কি না। ট্রাইক্লোসান থাইরয়েড হরমোন মেটাবলিজমে বাধা দেয়। দীর্ঘদিন ধরে ট্রাইক্লোসানযুক্ত পণ্য ব্যবহারে শিশুদের অ্যালার্জি, অ্যাজমা ও একজিমা রোগের আশঙ্কা দেখা দেয়।
আমরা যে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করি, সেটিতে যদি আইসোপ্রোপাইল ইথানল ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ থাকে, তাহলে সেটি ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার মতো জীবাণু ধ্বংস করে। কিন্তু অনেক সময় ভেজাল বা নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজারে মিথানল ব্যবহার করা হয় যা বিষাক্ত। মিথানলযুক্ত পণ্য ব্যবহারে ত্বকের প্রদাহ থেকে শুরু করে মৃত্যুর ঝুঁকিও হতে পারে।
ট্রায়োটক্সিন
সাধারণত আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ময়েশ্চারাইজার ও প্রসাধনীগুলোয় ফথালেট, ফরম্যালডিহাইড ও টলুইন থাকে। এই তিনটিকে একত্রে বলা হয় ট্রায়োটক্সিন। এই ট্রায়োটক্সিন হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে। কোনো গর্ভবতী নারী যদি ট্রায়োটক্সিনযুক্ত পণ্য ব্যবহার করেন, সেটি কিন্তু গর্ভের শিশুর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। সুতরাং ট্রায়োটক্সিনমুক্ত পণ্য কিনবেন, ট্রায়োটক্সিনযুক্ত পণ্য নয়।
প্রসাধনসামগ্রী
প্রথমেই বলছি মেকআপ প্রোডাক্ট নিয়ে। ফাউন্ডেশন, ফেস পাউডার, প্রাইমার—এগুলো ব্যবহারের পর অনেক সময় ত্বকে নানা ধরনের র্যাশ বা ব্রন দেখা দেয়। সে কারণেই ত্বকের ধরন অনুযায়ী প্রসাধনীগুলো কিনতে হবে। যেকোনো মেকআপ প্রোডাক্ট কেনার আগে দেখবেন, সেটা যেন নন–কমেডোজেনিক হয়।
লিপস্টিক
লিপস্টিকে সাধারণত মার্কারি, ক্যাডমিয়াম, লেড—এ ধরনের কেমিক্যাল ও টক্সিন থাকে। দীর্ঘদিন ধরে এসব উপাদানযুক্ত লিপস্টিক ব্যবহারে লিপ অ্যালার্জি, ইরিটেশন, চ্যাপড লিপ, ডিসকালারেশন ইত্যাদি দেখা দেয়। শুধু তা–ই নয়, দীর্ঘদিন ব্যবহারে আমাদের ডাইজেস্টিভ সিস্টেম, রেনাল সিস্টেম ইত্যাদিতে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। অনেক সময় লিপস্টিকে রেট্রো কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়, যেগুলো সাধারণত প্রাকৃতিক তেল ও গ্যাসের বাইপ্রোডাক্ট। এসব রেট্রোকেমিক্যাল স্নায়ু ও মস্তিষ্কের উন্নয়নে বাধা দেয়। এসব সমস্যা সাধারণত মেয়েদেরই হয়। কারণ, মেয়েরা বেশি পণ্য ব্যবহার করেন। গবেষণায় দেখা গেছে যে একজন ছেলে যদি ছয়টি প্রসাধনী ব্যবহার করেন দিনে, একটি মেয়ে তার দ্বিগুণ অর্থাৎ কমপক্ষে বারোটি প্রসাধনী ব্যবহার করেন।
সুতরাং, আপনারা নকল ও ভেজাল পণ্যে নিজেকে হারিয়ে যেতে দেবেন না। অনেক সময় পুরোনো কনটেইনার বা বোতলে এসব ভেজাল সামগ্রী রিফিল করে আবার বিক্রয় করা হয়। তাই আপনারা যেকোনো অথেনটিক প্রোডাক্ট ব্যবহারের পরে বোতলগুলো নষ্ট করে ফেলবেন, যেন এটি পুনর্ব্যবহারযোগ্য না থাকে। আপনার ত্বকের ধরন বুঝে প্রসাধনী ব্যবহার করুন। যেকোনো প্রসাধনী কেনার আগে মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখটি দেখে নেবেন। সেটার পিএইচ ব্যালেন্স আছে কি না এবং ডার্মাটোলজিস্ট টেস্টেড কি না, তা–ও দেখে নেবেন।
লেখক: ওয়েলনেস অ্যান্ড বিউটি কনটেস্ট কনসালট্যান্ট এবং বন্ধুসভা জাতীয় পর্ষদের স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া সম্পাদক