শহরের কোলাহল আর ব্যস্ততা ছেড়ে সুন্দরবনে একদিন

সুন্দরবনের করমজলে লেখক ও তাঁর বন্ধুরাছবি: লেখকের সৌজন্যে

অনেক দিন ধরে ইচ্ছা ছিল বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার। শহরের কোলাহল আর ব্যস্ত জীবনের ক্লান্তি দূর করতে প্রকৃতির মধ্যে ডুবে যাওয়ার চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না। বন্ধু আনিস, আবদুল্লাহ এবং আরও কয়েকজন— নাঈম, ফাহিম, রুহি, ফারুক, জয়ন্ত, শরিফ ও তাঁর ছোটভাই আর আমাদের বড় ভাই মিলনদাসহ বেশ কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম সুন্দরবন যাব।

যাত্রার দিনটি ছিল রবিবার। ভোর পাঁচটায় সবাই মিলে একটি ট্রলার ভাড়া করে রওনা দিলাম খুলনা দৌলতপুরের ভৈরব নদী থেকে। ভোরের ঠান্ডা বাতাস আর কুয়াশা মুড়ে থাকা নদী যেন আমাদের যাত্রাকে আরও রোমাঞ্চকর করে তুলে। কুয়াশায় ঢাকা প্রকৃতি যেন এক অলৌকিক দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। শীতের রেশ তখনো মিলিয়ে যায়নি। ট্রলার চলতে চলতে প্রকৃতির রূপ বদলাতে থাকে। কুয়াশা কেটে যায়, আকাশে দেখা যায় রোদের মেলা। আনিস আমাদের দলের প্রাণ। পুরো যাত্রাপথে তাঁর হাসি-ঠাট্টা, গল্প আর গান আমাদের ক্লান্ত হতে দেয়নি।

প্রথম গন্তব্য মোংলা। সেখানে পৌঁছাতে প্রায় চার ঘণ্টা লেগে যায়। সকালের নাশতা করলাম ট্রলারের ভেতর। মনে হচ্ছিল আমরা কোনো অজানা রোমাঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। নদীর মাঝখানে এসে চারপাশে তাকিয়ে দেখি, প্রকৃতির এক বিশাল অরণ্যের মাঝখানে এসে পড়েছি। দূরে ম্যানগ্রোভ গাছের সারি আর নদীর জল আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল।

সুন্দরবন ভ্রমণের প্রথম ধাপই হলো বনের ভেতর ঘুরে দেখা। করমজলে নেমে ফরেস্ট বোর্ড দেখলাম। সেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা বিভিন্ন নিয়ম কানুন, সুন্দরবন ঘুরতে হলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম মানতে হবে। প্রথমত, কোনোভাবেই বনের প্রাণীদের বিরক্ত করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, জঙ্গলের ভেতরে কখনো দল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না। নদীর পানির শব্দ, গাছের পাতা নড়ার মৃদু আওয়াজ আর পাখির ডাক মিলে এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করেছিল। আনিস ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। সে নদীর পানিতে মাছ ধরার চিত্র, ম্যানগ্রোভের শিকড় আর আকাশে উড়ন্ত পাখির ছবি তোলে।

সুন্দরবনে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার। তবে এদের দেখা পাওয়া বেশ কঠিন। সবার মনেই উত্তেজনা কাজ করছিল। রেলিং দিয়ে হাঁটার সময় ফয়সাল বলল, ‘ওই দেখ, বাঘের পদচিহ্ন!’ আমরা সবাই পাশে ঝুঁকে পড়লাম। সত্যিই, বালুর মধ্যে বাঘের বড় বড় পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে। সবার মনই খুশিতে ভরে উঠল; যদিও বাঘের সরাসরি দেখা পাওয়া সম্ভব হয়নি। আমাদের পাশ থেকে একজন যেতে যেতে জানালেন, ‘বাঘ খুব লাজুক প্রকৃতির। তবে, এরা সব সময় আপনাদের দেখছে, এমনকি যদি আপনারা এদের না দেখেন।’ কথাটা শুনে মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল যেন।

জঙ্গলের একটু গভীরে প্রবেশ করেই হঠাৎ দূরে একঝাঁক হরিণ দেখতে পেলাম। ওরা খুব সাবধানে ঘাস খাচ্ছিল। নাঈম আনন্দে চিৎকার করে উঠল, ‘ওই দেখো হরিণ!’ এরপর একটু দূরেই বিশাল একটি কুমিরকে রোদ পোহাতে দেখলাম। কুমিরটি বড় বড় দাঁত বের করে হাঁ করে শুয়ে আছে। জয়ন্ত ক্যামেরায় মুহূর্তটি বন্দী করল। গহীন জঙ্গল এবং বানরদের চিৎকারের পাশাপাশি সেখানে একটি টাওয়ার ছিল, যার ওপর থেকে বিশাল বড় জঙ্গল উপভোগ করি।

বিকেলের দিকে ট্রলারে ফিরে আসি। সূর্য ধীরে ধীরে অস্ত যেতে শুরু করল। নদীর জলে সূর্যের প্রতিফলন দেখে মনে হচ্ছিল, প্রকৃতি যেন তার রঙের প্যালেট নিয়ে খেলছে।

ফিরে আসার পথে সবাই বেশ চুপচাপ ছিলাম। প্রকৃতির এত সুন্দর জায়গা থেকে দূরে চলে যাওয়ায় হয়তো মন একটা ভার ছিল। একসঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো, সুন্দরবনের নৈসর্গিক সৌন্দর্য আমাদের স্মৃতির অমূল্য অংশ হয়ে থাকবে।

শিক্ষার্থী, সরকারি ব্রজলাল কলেজ, খুলনা