নির্বাক সহযাত্রী

অলংকরণ: আরাফাত করিম
বাইরে থেকে কেউ যদি আমাদের এই মুহূর্তে দেখত? একটা ছবি তুলত? কেমন লাগত সেই ছবি? হয়তো ফ্রেমবন্দী হতো দুটি মুখ—একসঙ্গে, অথচ দুই ভিন্ন জগতে বন্দী।

পঞ্চগড় থেকে ঢাকার পথটা দীর্ঘ। সেদিন আরও দীর্ঘ মনে হচ্ছিল। যেন সময় থমকে গেছে, ট্রেনের গতির সঙ্গে মনও চলছে ধীর, অবচেতনে আটকে আছে কোথাও। এই দীর্ঘ পথে কতবার ভেবেছি, কথাটা বলে ফেলি! কিন্তু মুখ খুললেই মনে হয়, শব্দেরা ম্রিয়মাণ হয়ে আসবে, হারিয়ে যাবে ট্রেনের শব্দের আড়ালে।

সে ছিল আমার পেছনের আসনে। এত কাছাকাছি, অথচ কত দূরে! জানালার কাচে আলোছায়ার খেলা পড়ছিল, তার মুখের একঝলক ছায়া আমার পাশে এসে থেমে যাচ্ছিল, আর আমি অপলক তাকিয়ে থাকতাম সেই ছায়ার দিকে। ট্রেন গড়িয়ে চলছিল, আমরাও চলছিলাম একসঙ্গে, অথচ আলাদা। কত স্টেশন পেরিয়ে গেল, কত যাত্রী উঠল-নামল, আমরা একবারও কথা বললাম না। অথচ মনে হচ্ছিল, বাতাসের ভেতরেও হয়তো এক অসমাপ্ত কথা ভেসে বেড়াচ্ছে, যা কেউ উচ্চারণ করতে পারছে না।

উল্লাপাড়া স্টেশনে ট্রেন থামল, প্রায় দুই ঘণ্টার বিরতি। বাইরে দোকানির হাঁকডাক, চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছে, যাত্রীরা কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছে, কেউবা জানালার ধারে বসে অলস সময় পার করছে। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম, সে–ও একইভাবে তাকিয়ে রইল। একবার চোখে চোখ পড়ল, একমুহূর্তের জন্য মনে হলো, সব বাধা ভেঙে কথা বলে ফেলি। কিন্তু আমরা চোখ ফিরিয়ে নিলাম।

কখনো কি ভাবিনি, এই মুহূর্তে ওর ঠোঁট নড়ে উঠবে, হয়তো বলবে—‘কেমন আছ?’ কিংবা আমিই বলে ফেলব—‘এত চুপচাপ কেন?’ কিন্তু না, কিছুই বলা হলো না।

রাত গভীর হচ্ছিল, ট্রেন ছুটে চলছে। বাইরে গাঢ় অন্ধকার, মাঝেমধ্যে দূরবর্তী গ্রামের বাড়িগুলোয় ছোট ছোট আলোর বিন্দু জ্বলছিল-নিভছিল। আলোদের মতোই আমাদের স্মৃতিগুলোও একেকটা মুহূর্তে জ্বলে উঠছিল, আবার মিলিয়ে যাচ্ছিল অন্ধকারে।

বাইরে থেকে কেউ যদি আমাদের এই মুহূর্তে দেখত? একটা ছবি তুলত? কেমন লাগত সেই ছবি? হয়তো ফ্রেমবন্দী হতো দুটি মুখ—একসঙ্গে, অথচ দুই ভিন্ন জগতে বন্দী। একজন সামনের দিকে তাকিয়ে, অন্যজন জানালার বাইরে-মাঝখানে নীরবতার এক দুর্ভেদ্য দেয়াল।

ঢাকার কাছাকাছি পৌঁছে ট্রেনের গতি একটু কমে এল। বুঝতে পারছিলাম সময় ফুরিয়ে আসছে, এই সফরের শেষ বাঁকে পৌঁছে গেছি আমরা। একবার ভাবলাম, নামার আগে একটু পেছনে তাকিয়ে দেখি। কিন্তু ভয় হলো, যদি সে তাকিয়ে থাকে, তাহলে? না তাকালে তো আরও কষ্ট!

শেষ স্টেশনে সে–ও দাঁড়াল, আমিও দাঁড়ালাম। তারপর দুজন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম।

বন্ধু, পঞ্চগড় বন্ধুসভা