আমাদের বাসা ছিল চট্টগ্রামের হরিশ্চন্দ্র মুন্সীপ লেনে জেলেপাড়ায়। সবাই পাথরঘাটা জাইল্যাপাড়া বলত। জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার পর থেকে শৈশবে এই বাসাতেই বেড়ে ওঠা। বাবা-মায়ের মুখে শুনেছি, আমার জন্মের পর দুইবার আমাদের ঘর পুড়ে গিয়েছিল। বাকলিয়াতে একটা বেড়ার ঘরে ভাড়া থাকতাম। বাবা দোকানে দোকানে বিয়ারিং সাপ্লাই করত। একদিন বাইরে কাজ থেকে সবে ফিরেছে, মা চা বসিয়েছে; হঠাৎ চিৎকার শোনা গেল পাশের বাড়িতে আগুন লেগেছে। কোনোরকমে আমাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে এল বাবা-মা। ঘরের সবকিছু চোখের নিমেষে পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
এরপর ঘর ভাড়া নেওয়া হলো বাকলিয়াতে। বাবার আর্থিক অবস্থা ততটা ভালো নয়। কম ভাড়াতে আবার একটা বেড়ার ঘরে গেল। অসুস্থ হলে একদিন আমাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেল। ফিরে এসে বদ্ধ ঘরের তালা আর খুলতে হয়নি। আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে দুবার ঘর পুড়ে গেল। যা-ই হোক, বাবা এবার কিছুটা সাহস করে একটা বিল্ডিংয়ের দোতলায় ঘরভাড়া নিল। বড় বড় তিনটি রুম, রান্নাঘর, দুটি বাথরুম সামনে আর পাশে লম্বা বারান্দা। এই ঘরে এসে আমার বোনের জন্ম, এরপর ভাই। আমাদের তিন ভাই-বোনের বেড়ে ওঠা।
দোতলার বাসার সামনেই ছিল জেলেপাড়ার মন্দির। সেই মন্দিরে দুর্গাপূজা হতো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে পূজা দেখতে পেতাম। তবে দুর্গাপূজার থেকেও কালীপূজাতে আনন্দ হতো বেশি। রাউজান উত্তর গুজরা গ্রামে বাবা ঠাকুমার হাতে গড়া একটা কালীমন্দির আছে। ঠাকুরদা, ঠাকুরমা আর জেঠুর পরিবার গ্রামে থাকত। ঠাকুরমা নিজের হাতে রোজ কালীপূজা করতেন। বছরে একবার বাবা অনেক টাকা খরচ করে বড় পূজার আয়োজন করত। তখন শহর থেকে আমরা গ্রামে যেতাম।
নার্সারিতে পড়তাম সেন্ট স্কলাস্টিক স্কুলে। পাথরঘাটা বড় গির্জার মূল গেটের ঠিক উল্টো দিকে ছিল এই স্কুল। সবাই স্কুলটাকে পাথরঘাটা গির্জা স্কুল বলত। এই গির্জা স্কুলে পড়ার সময় থেকেই জেলেপাড়ার মন্দিরের ভেতরে একটু একটু করে দেখতাম খড়ের বেণি পাকিয়ে, তার ওপর মাটি দিয়ে দুর্গাপ্রতিমা গড়ে উঠছে। পাশে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী। প্রতিমা তৈরি যতটা এগোত বুঝতে পারতাম, পূজা এগিয়ে আসছে। তত দিনে বাবা নতুন জামাকাপড় কিনে আনতেন। এরপর ক্লাস টুতে গিয়ে ভর্তি হলাম ফিরিঙ্গী বাজারে জে এম সেন কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। সেন্ট প্লাসিডস স্কুলটা ছিল আমার পিসির বাসার সঙ্গে লাগানো। পিসির ছেলেরা ওখানে পড়ত। পিসামশাই চেয়েছিলেন আমাকেও ওখানে ভর্তি করাতে। কিন্তু জে এম সেন স্কুলটা আমার একটু বেশি ভালো লাগল। প্রথম প্রথম বাবা-মা, মাসির ছেলে ওরা আমাকে স্কুলে দিয়ে আসত, নিয়ে আসত। ফোর-ফাইভে ওঠার পর বন্ধুদের সঙ্গে বা একাই পাথরঘাটার বাসা থেকে স্কুলে চলে যেতাম। রাস্তাগুলো ধীরে ধীরে চেনা হয়ে গেল।
পূজাতে সন্ধ্যাবেলা বাসার বারান্দায় বসে জেলেপাড়ার মন্দিরের আরতি দেখতাম। দিনের বেলা মায়ের সঙ্গে পূজা দিতে যেতাম। এরপর বাবা-মা, ভাই-বোন মিলে শহরের পূজা দেখতে যাওয়া। চটপটি, পোলার আইসক্রিম, কেক, পানীয় এসব খেয়ে বাড়ি ফিরতাম।
বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুরে দেখা পূজামণ্ডপগুলো এবার চেনা হয়ে গেল। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় থেকে শিমুল, সুমন, অ্যালভেনসহ কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বা ভাইকে নিয়ে পূজা দেখতে যেতে শুরু করলাম পাথরঘাটা বালিকা বিদ্যালয়ে। পাথরঘাটা গির্জা স্কুলের ওদিকটায়, কর্ণফুলী নদীর ধারে আশপাশের মণ্ডপগুলোতে। সেখান থেকে আলকরণ এক দিদার বাড়ি হয়ে সদরঘাট কালীবাড়ী। আমাদের বাসার সামনে জেলেপাড়ার মন্দিরের পূজাটা অন্য একটা জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়। ফলে বারান্দায় বসে আর পূজা দেখা হয় না।
ক্লাস সিক্সে কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য বাবা আবার খুব তোড়জোড় শুরু করেন। একজন স্যারের কাছে পড়তেও যেতাম। কিন্তু নিউমার্কেটের পাশে মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলটা দেখে আমার মনে ধরে গেল। সবার মুখে শুনলাম, ওই স্কুলে আবার দুপুরে টিফিন খেতে দেয়। জে এম সেন কিন্ডারগার্টেন স্কুলের বন্ধুরা ওখানে ভর্তি হয়েছে। কলেজিয়েট স্কুলটা ছিল বাবার বিয়ারিংয়ের দোকান সদরঘাট কালীবাড়ীর কাছে। স্কুলে যেতে আসতে বাবার চোখে পড়বে। বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরা যাবে না। তাই মিউনিসিপ্যাল স্কুলে যাওয়া। আর ওখানে নিয়মিত যাতায়াত করতে গিয়ে বৃহস্পতিবার স্কুল হাফ ছুটির পর ঘুরেফিরে শহরে চেনাজানা রাস্তাও বেড়ে গেল।
পূজাতে বলুয়ার দিঘির পাড়ে অভয়মিত্র মহাশ্মশানে চলে যেতাম। ওখানে মরদেহ দাহ করা হয়। একটা বড় শিব আছে। বক্সির হাটের পাশে পূজামণ্ডপগুলো ঘুরে দেখতাম। একটা বড় জমিদারবাড়ির ভেতরেও পারিবারিক পূজা হতো। নামটা ভুলে গেছি। সেখান থেকে হেঁটে ঘাটফরহাদবেগ মামার বাসায় গিয়ে ঘুরে আসতাম। সেখান থেকে বেরিয়ে আবার জে এম সেন হলে পূজা দেখতে যাওয়া। আন্দরকিল্লা বইয়ের দোকানগুলোতে একটু ঘুরে বেড়ানো, দু-একটা বই কেনা।
মুসলিম স্কুল, কোতোয়ালি থানার সামনে দিয়ে হেঁটে এসে গির্জার মাঠের কাছে পিসির বাড়িতে উঠতাম। পিসির মেয়ে অপটিমার সঙ্গে ওর বান্ধবীর বাড়িতে যাওয়া। রাতে আবার বাবা-মায়ের সঙ্গে চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের কাছে রামকৃষ্ণ মিশনের পূজা দেখতে যাওয়া। এভাবে মহা ব্যস্ততায় ঘুরেফিরে, খেয়েদেয়ে কেটে যেত তিনটা দিন। ক্লাস সেভেন পাস করা পর্যন্ত পূজাতে এবং অন্য সময়ে পায়ে-পায়ে গোটা চট্টগ্রাম শহরের অনেক জায়গা ঘুরেছি।
পূজাতে মনে হতো সপ্তমী থেকে নবমী—তিনটা দিন খুবই কম সময়। তার মধ্যে দুই দিনের পূজা কখনো যদি এক দিনে হয়ে যেত, তবে তো আরও মন খারাপ। হঠাৎ করে বিজয়া এসে বিসর্জনের বাজনা বেজে উঠত। কর্ণফুলী নদীতে নৌকা ভাড়া করে বাবার সঙ্গে দুই তিন বছর প্রতিমা নিরঞ্জন দেখেছি।
একসময় কর্ণফুলী নদীতে আবার বিসর্জন নাকি বন্ধ হলো। পতেঙ্গার ওই দিকে সবাই প্রতিমা নিয়ে যায়। বাবার কাছে বায়না ধরলাম সেখানে যাব। বাবা নিয়ে গেল না, কোতোয়ালি থানার কাছে একটা স্টুডিওতে বাবার সঙ্গে আমরা তিন ভাই-বোন ছবি তুললাম। মধুবন বিস্কুটের দোকান থেকে কিছু ভালো বিস্কুট কিনে, ঢাকা মিষ্টান্ন ভান্ডার নামের মিষ্টির দোকানে মিষ্টি খেয়ে আবার বাড়ি ফিরে এলাম।
প্রতিবার বিজয়া দশমীতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে মহিষাসুর মর্দিনী দেখানো হতো। অমল বোস প্রতিবার অসুর হতেন। এই অসুরকে দেখে বেশ আনন্দ পেতাম। রাতে টিভিতে মন খারাপের মধ্যে এই মহিষাসুর বধ নাটক দেখে কিছুটা দুঃখও কমে যেত।
সামনে কালীপূজাতে আবার এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাব। মনের মধ্যে সেই আনন্দ জেগে উঠত। একবার বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন দিতে গিয়ে পাথরঘাটা বালিকা বিদ্যালয় পূজা কমিটির এক তরুণ কর্ণফুলী নদীতে হারিয়ে গেল। পরদিন তার লাশ ভেসে ওঠে। সেই তরুণসহ তার পরিবারের সব ভাই-বোন আমার বাবার খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। বিজয়া দশমী সেবার চরম দুঃখে পরিণত হলো।
দুর্গাপ্রতিমা ভাসানের পর কোথায় চলে যায়? বিজয়ার দিন সকালে উঠে বাংলা খাতায় আমরা ১০৮ বার দুর্গা নাম লিখতাম। মা যখন জেলেপাড়ার মন্দিরে দেবী বরণ করতে যেত, দুর্গার হাতে সেই কাগজ ভাঁজ করে চিঠির মতো গুঁজে দিতাম। একবার ১০ হাতের কোথাও জায়গা না পেয়ে সিংহের মুখের ভেতরে চিঠি গুঁজে দিয়েছি। ভাই বলল, ‘সিংহ খিদে পেলে তোর চিঠি খেয়ে নেবে! দুর্গা আর পাবে না।’ আমার মনে হলো, সিংহ তা করবে না। ঠিক দুর্গাকে দিয়ে দেবে। আমাদের এই চিঠিগুলোই-বা কোথায় ভেসে যায়? সেই তরুণকেও কি তবে দুর্গা নিজের সঙ্গে নিয়ে চলে গেল? সেই পরিবারের আর্তনাদ শুনে দুর্গার ওপর খুব অভিমান হয়েছিল।
এরপর একটা সময় এসে আমরাও উদ্বাস্তু হলাম। জীবন থেকে পূজার আনন্দ মুছে গেল। উদ্বাস্তু জীবনের চরম যন্ত্রণা আমাকে অলৌকিক ভক্তি-বিশ্বাস থেকে দূরে সরিয়ে আনল। ধীরে ধীরে নাস্তিক হয়ে গেলাম। কলকাতায় বড় বড় পূজা হয়। গোটা পৃথিবীর সংবাদমাধ্যমের চোখ এসে পড়ে। আমি চার দিন চুপচাপ ঘরে বসে থাকি। কবিতা লিখি, বই পড়ি, বাংলাদেশের সিনেমা দেখি।
গত ডিসেম্বরে মাকে হারিয়েছি। এ বছর এমনিতেই তাই বুকের ভেতর বিসর্জনের শূন্যতা।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত