নিরঞ্জনার বয়স ১৭, এই বয়সেই জীবনের অর্ধেক মানে দেখে ফেলেছে। প্রজেক্টের কাজের সুবাদে বাগানে যাওয়া আর তার কথা শোনা। চেয়েছিলাম ছবি তুলতে, কিন্তু ফোকলা দাঁতের হাসিতে বুঝিয়ে দিল সে ছবি তুলবে না, সেটির জন্য অপ্রস্তুত।
সাল ২০০৮, চা–বাগানের একদম ছোট একটা কুটিরে তার জন্ম। জন্মের সময়ই মা মারা গেছে। মেয়েটির বাবার কান্নায় সেদিন পুরো আকাশ কান্না করেছিল, লোকমুখে শুনেছি। বাবাই তার সব। কাজের বয়স নয়, কিন্তু বাবার মুখে হাসি ফোটাতে বোঝার বয়স থেকেই কাজ করে নিরঞ্জনা।
পড়ালেখা করে জজ, ব্যারিস্টার, পুলিশ, ডিসি, ডাক্তার এসবের স্বপ্ন সে দেখতে পারেনি। কোনোরকমে পঞ্চম শ্রেণির গণ্ডি পার করেছে। গায়ের রং কালো, চেহারা মায়াবী।
আশপাশের সবাই এক নামে নিরঞ্জনাকে চেনে, স্নেহ করে।
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এত পরিশ্রমের পরে যে বেতন পাও, সেই বেতনে কি তোমাদের সংসার চলে?’ বলল, ‘না, তবে কষ্ট করে চলি আরকি।’
কথা বলতে বলতে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেল। আমাকে সামনে রেখেই কাঁচা পেঁয়াজ আর শুকনা মরিচ, সঙ্গে একটু লবণ আর নতুন, মানে বাড়ন্ত চায়ের পাতা দিয়ে ভর্তা করল শর্ষের তেল মাখিয়ে। আমার হাতে একটু দিয়ে বলল, চেখে দেখেন কেমন হইল?
আমিও মুখে দিলাম। ঝালের বদলে চা–পাতার উগ্র ঘ্রাণটা নাকে শুরুতে আঘাত করল।
আগের রাতে রান্না করা ভাত, বানানো ভর্তা, সঙ্গে পেঁয়াজ পোড়া আর কাঁচামরিচ ও শুকনা ডাল—নিরঞ্জনার কাছে এগুলোই বিশ্বখ্যাত শেফের বানানো খাবারের স্বাদের মতোই।
ততক্ষণে আরেকজন চা–শ্রমিকের ইন্টারভিউ নিয়ে আবার নিরঞ্জনার কাছে গেলাম। সে হাসিমুখে বলল, ‘দাদা, আপনারা অনেক ভালো ভালো জায়গায় কাজ করেন, আমাদের কাছে অনেক সময় অনেক লোক আসেন। তাঁরা আশ্বাস দিয়ে আবার চলে যান, আর আসেন না। কিন্তু আপনাদের দেখলাম সাত দিন ধরে কাজ করছেন। আমাদের ভালোর জন্যই কাজ করতেছেন। তাই কথা বলতেছি আপনাদের সঙ্গে।’
সবচেয়ে ছোট হওয়ায় তার ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় কথাগুলো আমার কাছে কিছুটা ভিন্ন মনে হলো।
একচালা ঘর। বৃষ্টি হলে পানি ঘরের মধ্যে পড়ে। বালতি, ডেক দিয়ে পানি ধারণ করা হয়। ঘরের চালের ছিদ্র কোনোভাবে সারানো হলে আবার সেগুলো বেশি বৃষ্টির কারণে নষ্ট হয়ে যায়। নিরঞ্জনা বলে, ‘যা টাকা পাই, তা দিয়ে খাব কী, আর ঘর সারাব কী দিয়ে।’
নিরঞ্জনা বলতে থাকে, ‘দাদা, জীবনের মানে এখন আর খুঁজি না। কাজ করে যাই আর পরবর্তী দিন কী কাজ করব, তা–ই চিন্তা করি।’
কথাটা আমার অন্তরে নাড়া দিল। আসলেই তো, আমরা প্রাত্যহিক জীবনে কত কাজ করি, কাজের ফাঁকে কত আড্ডাবাজি, কতশত গল্প, পরিবারের চাওয়া ও পাওয়া—সবকিছু নিয়ে একটা সারাংশ দাঁড় করিয়ে রাতে ঘুমাতে যাই। পরদিন ঘুম থেকে উঠে আবার কাজ করি, আবার স্বপ্ন বুনতে শুরু করি। মানুষের জীবন কতই বিচিত্রময়। রঙিন দুনিয়ায় আমরাও নিরঞ্জনার মতো বেঁচে আছি। সে তার কাজের মধ্যে, আমরা আমাদের কাজের মধ্যে।
সভাপতি, মুরারিচাঁদ কলেজ বন্ধুসভা