সাকিব, বিতর্ক এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট

সাকিব আল হাসান
ফাইল ছবি

এক সাক্ষাৎকারে সাকিব আল হাসান বলেছিলেন, তিনি না থাকলে দেশের মিডিয়াগুলো এত নিউজ পেত কই? মজার ছলে বললেও কথাটা একেবারে অসত্যও বলেননি তিনি। একের পর এক ইস্যু, একের পর এক বিতর্ক, সব জায়গায় একটাই নাম—সাকিব আল হাসান। ভক্ত-সমর্থক থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে তিনি। প্রতিটি সিরিজ কিংবা টুর্নামেন্ট শুরুর আগে একটাই প্রশ্ন, সাকিব খেলবেন তো? সম্প্রতি এই সমস্যারও খানিক সমাধান মিলেছে। আবারও ফিরে পেয়েছেন জাতীয় দলের নেতৃত্ব। প্রথমে টেস্ট, এবার পেলেন টি-টোয়েন্টির অধিনায়কত্ব। ফলে এই দুটি ফরম্যাটে যে এখন থেকে তাঁকে নিয়মিত পাওয়া যাবে তা বলাই যায়।

তবে বিতর্ক থেমে নেই। এই যেমন সদ্য সমাপ্ত জিম্বাবুয়ে সিরিজে সাকিব খেলেননি। তবু সর্বত্র ছিলেন তিনি। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি—দুটি সিরিজেই স্বাগতিকদের কাছে পরাজিত হয়েছে বাংলাদেশ। দেশের মিডিয়ায় দলের এমন ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা যেন ভুলে গেল সবাই। সব ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে সাকিব আল হাসান। বেটউইনার নামে একটি ওয়েবসাইটের সঙ্গে বিতর্কিত চুক্তি করেছেন তিনি। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে স্বয়ং বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন বলেছেন, হয় এই চুক্তি বাতিল করতে হবে, নয়তো দেশের ক্রিকেটের সঙ্গে সাকিবের কোনো সম্পর্ক থাকবে না।

তবে এখন স্বস্তির খবর, চুক্তি বাতিল করেছেন সাকিব এবং তাঁর হাতে আবারও তুলে দেওয়া হয়েছে টি-টোয়েন্টির অধিনায়কত্ব। আসন্ন এশিয়া কাপ, ত্রিদেশীয় সিরিজ ও অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠেয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত দলের নেতৃত্ব দেবেন তিনি। মেয়াদ আরও বাড়তে পারে। সর্বমহলে স্বস্তি- অবশেষে বিতর্ক শেষ হলো! আসলেই কি শেষ হয়েছে?

সাকিব আল হাসান এবং মাশরাফি বিন মুর্তজা
ফাইল ছবি

অতীত ইতিহাস বলে সাকিব এবং বিতর্ক যেন একই সূত্রে গাঁথা। দেশের ইতিহাসের সেরা এই ক্রিকেটারকে নিয়ে প্রথম সমালোচনা শুরু হয় ২০১১ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপের সময়। সেবার চোটের কারণে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে রাখা হয়নি। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের সামনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে নড়াইল এক্সপ্রেস–খ্যাত এই পেসার দাবি করেছিলেন, তিনি খেলার মতো ফিট আছেন। সমালোচকদের অভিযোগ ছিল, তৎকালীন অধিনায়ক সাকিবের কারণেই খেলতে পারেননি মাশরাফি। যদিও পরে বিভিন্ন সময় এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন মাশরাফি নিজেই।

পরের বছর অধিনায়কত্ব হারান সাকিব। তাঁর বিরুদ্ধে দলের ভেতর শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ ওঠে। নেতৃত্ব দেওয়া হয় মুশফিকুর রহিমের কাঁধে। এরপরও বিতর্কের সঙ্গে সাকিবের সখ্য কমেনি। ড্রেসিংরুম থেকে ক্যামেরা দেখে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করা, দর্শকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার, বোর্ড থেকে নিষিদ্ধ হয়ে দলের বাইরে যাওয়া, মাঠে আম্পায়ারের সঙ্গে বাজে ব্যবহার এবং সবচেয়ে বড় বিতর্কটা আসে ২০১৯ সালে আইসিসি থেকে এক বছরের নিষেধাজ্ঞা পেয়ে। জুয়াড়ির প্রস্তাব পেয়ে তা গোপন রেখেছিলেন সাকিব, যা আইসিসির নীতিমালাবিরোধী। তবে আলোচনা থেকে কখনোই হারিয়ে যাননি তিনি। নিষেধাজ্ঞার কয়েক মাস আগে বিশ্বকাপে অতিমানবীয় পারফরম্যান্স দেখিয়ে নতুন করে বিশ্ব ক্রিকেটের নজরে আসেন তিনি। আর নিষেধাজ্ঞার পর করোনা মহামারি শুরু হয়। সে সময় মানুষের সেবায় বিভিন্নভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তাই ক্রিকেটের বাইরে থাকলেও কখনোই আলোচনার বাইরে থাকেননি এই ক্রিকেটার।

নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ২০২১ সালের শুরুতে আবারও জাতীয় দলে ফেরেন সাকিব আল হাসান। এবার নতুন বিতর্ক—তাঁর ছুটি নেওয়া কেন্দ্র করে। প্রায় প্রতিটি সিরিজের আগেই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণ দেখিয়ে বিসিবির কাছে ছুটি চেয়ে বসেন। বোর্ডও শেষ পর্যন্ত ছুটি মঞ্জুর করে। ছুটি নিয়ে সর্বশেষ বিতর্ক হয় গত আইপিএলের সময়। ওই সময় জাতীয় দলের খেলা বাদ দিয়ে আইপিএলে খেলার অনুমতি চেয়ে বিসিবিতে চিঠি দেন সাকিব। বোর্ড থেকেও তাঁর ছুটি মঞ্জুর হবে বলে গুঞ্জন শোনা যায়। যদিও শেষ অবধি আইপিএলের কোনো ফ্রাঞ্জাইজি তাঁকে কেনেনি। পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ থেকেও মানসিক কারণ দেখিয়ে ছুটি নেন। অবশ্য পরে অনেক নাটকীয়তা শেষে খেলতে সম্মত হন।

সাকিব আল হাসান মানেই এমন কিছু ছবি!
শামসুল হক

এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে বিতর্ক শেষে জাতীয় দলে সাকিবের প্রত্যাবর্তন সব সময়ই দেশকে আনন্দের উপলক্ষ এনে দিয়েছে। তাই ভক্তদের চাওয়া, বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের নেতৃত্বে আবারও সেরা ফর্মে ফিরবে বাংলাদেশ এবং এশিয়া কাপেই সেটির ঝলক দেখা যাবে। তিনি যদি এই দলটিকে আবারও গুছিয়ে আনতে পারেন, সেটা সাকিব এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট উভয়ের জন্যই মঙ্গলজনক।