হারানো দেশ, ফুলের স্বর্গ, স্মৃতিতে পলাশের মাস

ভ্রাম্যমাণ দোকানে বিক্রি হচ্ছে ফুল, প্রতীকীছবি: হাসান মাহমুদ
মা বললেন, অনুমতি না নিয়ে কারও গাছের ফুলে হাত দিতে নেই। সেই থেকে একটা বড় শিক্ষা পেলাম, ‘সৌন্দর্যকে দূর থেকে উপভোগ করতে হয়, ছিনিয়ে আপন করে নিতে গেলে সৌন্দর্য হারিয়ে যায়।’

ছোটবেলায় চট্টগ্রাম শহরে ভোরে ঘুম থেকে তুলে বাবা আমাকে ফুল আনতে পাঠাতেন। আমি ফুল নিয়ে এলে স্নানের পর বাবা পূজায় বসতেন। আমাদের পাথরঘাটা জেলেপাড়ার দোতলার ভাড়া বাসার বারান্দায় মা টবে অনেক ফুলগাছ লাগাতেন। চারতলার ছাদেও টবের মধ্যে মায়ের লাগানো ফুলগাছ ছিল। সকাল-বিকেল মা গাছগুলোর পরিচর্যা করতেন। কিন্তু বিল্ডিংয়ের টবে চাষ করা গাছে কত আর ফুল ফুটবে। রোজ পূজায় অনেক ফুলের প্রয়োজন।

উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসার পর দেখলাম, এখানে প্রতিটি পাড়ায়, ছোট ছোট অঞ্চলে রোজ যে ছোট ছোট বাজার বসে; সেই বাজারেও একটা-দুটি করে ফুলের দোকান রয়েছে। বড় বড় বাজারে, রেলস্টেশনের ধারেকাছে বড় বড় ফুলের দোকান। রোজ বাড়িতে খবরের কাগজ দিয়ে যাওয়ার মতো অনেকে বাড়ি বাড়ি ফুলের প্যাকেটও দিয়ে যান। মাস শেষে ফুলের টাকা নিতে আসেন। আবার কলকাতায় হাওড়া ব্রিজসংলগ্ন গঙ্গার ধারে মস্ত পাইকারি ফুলের বাজার রয়েছে। এই ফুলের বাজারের কাছেই স্ট্র্যান্ড রোডে একটি সংস্থায় বর্তমানে চাকরি করি। রোজ তাই ফুলের জমজমাট বাজারে দেখতে পাই, ট্রাকভর্তি করে নানা রকমের ফুল আসছে। সারা দিন বস্তায় বস্তায় ফুল পাইকারি দরে জেলার ক্ষুদ্র ফুল বিক্রেতারা কিনে নিয়ে যান। পাড়ার ছোট ছোট ফুলের দোকানে গিয়ে খুচরা বিক্রি করেন। বেশির ভাগ ফুল পূজার জন্য লাগে, কখনো বিয়েবাড়ি বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজন হয়। কোনো রকম পূজা অনুষ্ঠান ছাড়াও শৌখিন মানুষ ঘরে বা অফিসে ফুলদানিতে রাখার জন্য গোলাপ, রজনীগন্ধা নিয়ে যান। সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গজুড়ে পাইকারি বা খুচরা শুধু ফুলের ব্যবসা করে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন। এভাবে পাড়ায় পাড়ায় অঞ্চলে অঞ্চলে ঢালাও ফুলের ব্যবসা ছোটবেলায় চট্টগ্রাম শহরে দেখিনি। ঠিক কোথায় কোথায় ফুলের দোকান দেখেছি, তা-ও আজ আর স্মৃতিতে নেই।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে ঘরের পূজার জন্য ফুল আনতে পাথরঘাটা গির্জা স্কুলের পাশে আমার পিসির বাসায় চলে যেতাম। তিনতলার ওপরে তাদের ভাড়া বাসার পেছনে বেশ কিছুটা উন্মুক্ত ফাঁকা জায়গা ছিল। সেখানে কলাপাতি ফুলগাছের রীতিমতো জঙ্গল তৈরি হয়ে যেত। আরও অন্যান্য গাছ থাকত। আমি আর পিসতুতো ভাইবোনেরা মিলে কলাপাতি ফুল তুলে পিসির জন্য সমান ভাগ করে রেখে, বাবার পূজার জন্য নিয়ে আসতাম।

আমাদের জেলেপাড়ার গলিটা দিয়ে বের হলে গির্জা স্কুলের সেই রাস্তায় একজনের বাড়ির গেটে বেগুনি রঙের কাগজ ফুল শোভা পেত। হিন্দুরা সব ফুল পূজাতে দেয় না; কিন্তু ফুল তো আর শুধু পূজা করার জন্য ফোটে না। দেখে যে আমি মুগ্ধ হচ্ছি প্রতিদিন, সেখানেই তার ফুটে ওঠার সার্থকতা। একদিন টেনে টেনে সেই কাগজ ফুল তুলছিলাম; এই বেগুনি রঙের কাগজ ফুলের ভিন্ন একটি প্রজাতি সম্ভবত বাগানবিলাস। মনের আনন্দে ফুল তোলার সময় হঠাৎ দেখলাম ভেতর থেকে কেউ একজন অনেকটা জল ছুড়ে মেরেছে। একেবারে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। আনন্দ মিলিয়ে গেল, রাগে-দুঃখে চোখে চলে এল জল। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি এসে মাকে সব কথা জানানোর পর সান্ত্বনা পাব দূরে থাক, উল্টো বকুনি খেলাম। মা বললেন, অনুমতি না নিয়ে কারও গাছের ফুলে হাত দিতে নেই। সেই থেকে একটা বড় শিক্ষা পেলাম, ‘সৌন্দর্যকে দূর থেকে উপভোগ করতে হয়, ছিনিয়ে আপন করে নিতে গেলে সৌন্দর্য হারিয়ে যায়।’

এদিকে রোজ রোজ পূজার ফুল আনতে পিসির বাড়িতে যেতেও ভালো লাগে না। বাবা শহরের বুকেই একটা বাগানের খোঁজ পেলেন, যেখান থেকে সরাসরি ফুল বিক্রি হয়। একদিন আমাকে চট্টগ্রামে লালদীঘির কাছে একেবারে ব্যস্ত রাস্তার পাশে সেই বাগানে নিয়ে গেলেন। যত দূর মনে পড়ছে, চট্টগ্রামের মূল শহীদ মিনারের লাগোয়া ছিল সেই বাগানটা। এখন স্মৃতিতে ৩০-৩২ বছর আগের সেই জায়গাগুলোও এলোমেলো হয়ে যায়। দেশ ছেড়ে আসার পর আমার তো আর কখনো যাওয়া হয়নি। যা হোক, সেই বাগান যিনি দেখাশোনা করেন, সেদিন সেই মালিকে কুড়ি টাকা দেওয়ায় অনেকগুলো লাল লঙ্কা জবা তুলে এনে দিলেন। এসব ফুলকে আমরা মরিচ ফুলও বলতাম। এর পর থেকে একা সেই বাগানে গিয়ে হাজির হতাম আর মালি আমাকেই বলতেন, গাছ থেকে ফুল তুলে নিতে। আগে যাওয়ামাত্র মালিকে কুড়ি টাকা দিয়ে দিতাম। আবার আমাকে যেহেতু ফুল তোলার স্বাধীনতা দিয়েছেন, কখনো এত বেশি ফুল তুলতাম না, যাতে তাঁর লোকসান হয়। বাগানে নিজের হাতে ফুল তোলার আলাদা একটা আনন্দ আছে। মালির সঙ্গে ভাব হওয়াতে এই আনন্দ বেড়ে গেল দ্বিগুণ।

নিজের হাতে ফুল তোলা আমার আরও একটা আনন্দের সময় ছিল কালীপূজার সময় বছরে একবার করে রাউজান উত্তরগুজরাতে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া। বাড়ির মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত এই পূজার মূল উদ্যোক্তা ছিল আমার বাবা। শহরে মানুষ যা হোক ফুল কিনে পূজা করে। গ্রামে তো আর ফুল কিনতে হয় না। প্রকৃতি মাঠে-ঘাটে চারদিকে অসংখ্য ফুল ফুটিয়ে রেখেছে আমাদের জন্য। পূজার আগের রাতে বাবা আর জ্যাঠা মিলে আমাদের মধ্যে বয়সে ছোট ও বড়দের দুটি দলে ভাগ করে দিতেন আশপাশের সব গ্রাম থেকে ফুল তুলে আনার জন্য। কোন দল কত বেশি ফুল তুলে আনতে পারবে, এটাও ছিল আমাদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা।

গ্রামে আমার আট-দশ বছর বয়সী সব আত্মীয় বন্ধুরা মিলে ভোরে ফুল তুলতে বেরিয়ে যেতাম। হিন্দুপাড়া, মুসলমানপাড়া, বৌদ্ধপাড়া—কোথাও থেকে ফুল তুলে আনতে বাকি রাখতাম না। আমি তো গ্রামের এসব জায়গা কিছুই চিনি না, শহরে থাকি। বন্ধুরা যেদিকে নিয়ে যায়, সেদিকেই ছুটি। আমাদের পূজাতে গ্রামের সবাই নিমন্ত্রিত হতো। ফলে স্বেচ্ছায় সবাই নিজের বাড়ির উঠান থেকে, বাগান থেকে ফুল তুলে আনার অনুমতি দিতেন।

ডালে ডালে ফুটেছে পলাশ ফুল
ছবি: এম সাদেক

কালীপূজার সময় গ্রামে বেশ শীত পড়তে শুরু করে। একবার ভোরে কাঁথা গায়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। একটা খালের ওপর দুটি বাঁশ রাখা, সেই বাঁশের ওপর দিয়ে বন্ধুদের হাত ধরে ওপারে একজনের বাড়িতে ফুল তুলতে গেলাম। কুকুর তাড়া করল। ছুটতে ছুটতে বন্ধুরা সেই বাঁশের ওপর দিয়ে আবার এপারে চলে এল। আর আমি কনকনে ঠান্ডার মধ্যে পা পিছলে আলুর দম, খালে পড়ে গেলাম। জল বেশি ছিল না, কাদার মধ্যে অর্ধেক শরীর ডুবে গেছে। শরীরে জড়ানো সেই কাঁথা সেখানে ছেড়ে, কোনোরকমে উঠে এসে আবার ছুটলাম।

ফুলের স্বর্গে প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে এই দুষ্টু মিষ্টি আনন্দের মধ্যেও প্রতিবছর বেদনা-বিজড়িত ফেব্রুয়ারি মাস এসে উঁকি দিত। শুরু হতো অন্য রকম মন কেমনের পালা। আমার মায়ের মুখের ভাষা, আমার জন্ম মুখের লালিত ভাষা, আমার ফুলের মতো বর্ণমালা, আমার জীবনের চলার পথের পরিচয়, আমার বাঙালি সত্তা, আমার ভালোবাসার প্রাণের ভাষার জন্য যে ভাইয়েরা একদিন প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁদের স্মরণে আমার শিমুল বোন, পলাশ ভাইয়ের ভাষা। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ভোরের সঙ্গে পলাশ ফুল কেমন যেন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে। গাছে গাছে আগুনের ফুলকির মতো এই সময়েই দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে পলাশের শোভা। ভাইয়েরা যেন বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বর্ণমালার এই কিরণ ফুটিয়ে দিয়ে গেছেন।

ঠিক এই সময়ে আবার সরস্বতী পূজাও এসে হাজির হয়। দুধকালি, খাগের কাঠির মতো বিদ্যাদেবীর আরাধনায় পলাশ ফুলও লাগে। আমাদের চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলের ঠিক পেছন দিকটায় রয়েছে চট্টগ্রাম কোর্ট। স্কুল থেকে জায়গাটা একটু উঁচুতে ছিল। পাঁচিল টপকে অনেকে স্কুল পালায় শুনেছি, আমরা স্কুল থেকে পাহাড় টপকে কোর্ট চত্বরে ওঠার চেষ্টা করতাম। এই ঢালু পাহাড়ি অংশে দু-তিনটা দারুচিনির গাছও ছিল। রান্নার জন্য বাড়িতে দারুচিনি কতবার কিনেছি। স্কুলে পেছনে গাছ থেকে দু-একজন দুষ্টু বন্ধুকে ছুরি দিয়ে বাকল ছাড়িয়ে নিতে দেখেছি। কাঁচা বাকল। অন্য দু-একজন বন্ধু দারুচিনির গাছে আবার সরাসরি দাঁতের কামড় বসিয়ে স্বাদ নেওয়ার চেষ্টা করত। এই গেছো বাঁদরদের উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ নাকি আদালত কর্তৃপক্ষ জানি না, সীমানাটা ঘিরে দিয়েছিল। স্কুল থেকে কোর্ট চত্বরে উঠে বেশ কিছু পলাশ ফুলের গাছ দেখতে পেয়েছিলাম। সেই প্রথম পলাশ ফুলের গাছের সঙ্গে আমার পরিচয়। এর পর থেকে সরস্বতী পূজার জন্য বাড়ির বড় কাউকে নিয়ে গিয়ে ওখান থেকে পলাশ ফুল পেড়ে আনতাম। একুশে ভোরে শহীদ মিনারে শোক-বিজড়িত শ্রদ্ধা অর্পণ করার জন্যও পলাশ ফুল নিয়ে এসে মালা গাঁথতাম।

আমার পাথরঘাটা জেলেপাড়ার সেই বিল্ডিংয়ের সমবয়সী আবাসিক বন্ধুরা এবং পাড়ার কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা ক্লাব তৈরির চেষ্টা করেছিলাম। নাম দিয়েছিলাম ‘উদিত সূর্য সংঘ’। ক্লাস সিক্স, সেভেন দু-বছর রাত জেগে আমরা ভাষা দিবসের পোস্টার লিখে দেয়ালে লাগিয়েছি। রাস্তায় আলপনা এঁকেছি। পলাশ ফুলের মালা নিয়ে ভোরে খালি পায়ে একুশের গান গাইতে গাইতে রওনা দিয়েছি শহীদ মিনারের দিকে।

যখন জে এম সেন কিন্ডারগার্টেন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম, তখনো স্কুল থেকে প্রতিবছর ভোরে প্রভাতফেরিতে হেঁটে যেতাম। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানিয়ে ফিরে এসে স্কুলে অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেছি। স্মৃতিগুলো আজ কেমন যেন স্বপ্ন মনে হয়।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত