শৈশবের ঈদস্মৃতি

প্রায় এক দশক আগের কথা। তখন স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি। বয়স সাত কিংবা আট। সে সময় আমাদের ঈদের আমেজ শুরু হতো শবে কদর তথা ২৭ রমজানের পর থেকেই। শবে কদর যেন ঈদের আগমনী বার্তা বয়ে আনত। ঈদের দুই-তিন দিন আগ থেকেই নানা প্রস্তুতি শুরু হতো। ২৭ রমজানে আমরা ছোটরা সবাই ঘরবাড়ি পরিষ্কারের কাজে বড়দের সাহায্য করতাম। ২৮ রমজান সারা দিন বন্ধুদের ঈদকার্ড বিতরণের কাজে ব্যস্ত থাকতাম।

নতুন কাপড় কিনে নিতাম রমজানের শুরুর দিকেই। কাপড় পুরোনো হয়ে যাওয়ার ভয়ে কাউকে দেখাতাম না। ২৯ রমজান সন্ধ্যাবেলা সবাই মিলে বিলে ছুটে যেতাম নতুন চাঁদ দেখার অভিপ্রায়ে। দেখতাম সূর্য ডুবে গেছে, কিন্তু দিগন্তজুড়ে এখনো রক্তিম আভার স্রোত। অপেক্ষায় থাকতাম, কখন সে স্রোতকে ম্লান করে আকাশে একফালি নতুন চাঁদ উঁকি দেবে। সবার হৃদয়ে থাকত ঈদের নতুন চাঁদ দেখার তীব্র বাসনা। চাঁদ দেখতে পেলেই খুশিতে আটখানা হয়ে যেতাম। বন্ধুদের নিয়ে বাজারে যেতাম আতশবাজি কিনতে। চাঁদরাতে আতশবাজি ফোটাতাম। অনেক সময় প্রচণ্ড আওয়াজে বিরক্ত হয়ে মুরব্বিরা বকাবকি করতেন। এ রাতে মেয়েদের দেখতাম হাতে পায়ে মেহেদি লাগাতে। আমরা ছোট ছেলেরা শুধু হাতের তালুতে মেহেদি লাগিয়ে ঘুমিয়ে যেতাম।

ঈদের দিন ঘুম থেকে উঠতাম খুব ভোরে। উঠেই গোসল সেরে নতুন পাঞ্জাবি গায়ে তুলে আতর মেখে চলে যেতাম ঈদগাহে। গিয়ে দেখতাম শত শত মানুষের সমাগম। ছোটদের কলরবে আর বড়দের পদভারে চারদিক মুখর। অনেক ছোট বাচ্চাকে দেখতাম এত মানুষের সমাগম দেখে ভয়ে কান্না করছে। তখন ঈদের নামাজ পড়ে খুতবা শোনার অপেক্ষায় থাকতাম না। দলবল নিয়ে বেরিয়ে আসতাম। আর সারা দিনের পরিকল্পনা ঠিক করে নিতাম। ঈদগাহ থেকে বেরিয়েই শুরু হতো আমাদের অভিযান। এলাকার সব ঘরেই দলবদ্ধ হয়ে ঢুঁ মারতাম সালামির লোভে। তখন সালামি পেতাম দশ থেকে শুরু করে বড়জোর পঞ্চাশ টাকা। সামান্য টাকাগুলোর মূল্য আমাদের কাছে আকাশচুম্বী ছিল। সারা দিন ঘুরে বেরিয়ে বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে সালামির হিসাব করতাম। বন্ধুদের মধ্যে যার সালামির পরিমাণ বেশি হতো, তার খুশির সীমা থাকত না। ঈদের দ্বিতীয় দিন থেকে আত্মীয়দের বাসায় বেড়াতে যেতাম। এভাবেই কাটত ঈদ সপ্তাহ। ঈদের ছুটি কাটিয়ে সপ্তাহব্যাপী ঈদ উদ্‌যাপনের গল্পগুলো আনন্দ চিত্তে স্কুলের বন্ধুদের খুলে বলতাম।

কালের পালাবদলে সোনালি দিনগুলো আর নেই। এখন ঈদকে ঘিরে তেমন পরিকল্পনা থাকে না। এখন আর চাঁদ দেখতে বিলে ছুটে যাই না। ইন্টারনেটের কল্যাণে এক দিন আগেই চাঁদের খবর জেনে যাই। ঈদকার্ড বিতরণের রীতিও এখন নেই। ঈদের সালাতে আর দুষ্টুমিতে মেতে উঠি না। সালামির লোভে সব বাড়িতে ঢুঁ মারি না। কেউ এখন সালামি দেয় না, বরং অনেকে সালামি চায়।

আজ বড় হয়ে গেছি। শৈশবের মধুর দিনগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। খুব ইচ্ছা করে সেই দিনগুলোতে আবার ফিরে যেতে। তা কি আদৌ সম্ভব? নাহ, কখনোই সম্ভব না। তাই সোনালি দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করেই আজ অবুঝ মনে সান্ত্বনার হাত বুলিয়ে দিই। তবু তো সেগুলো স্মৃতি।

চট্টগ্রাম