তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি। সারা দিন প্রচুর বৃষ্টি। স্কুলে আর যাওয়া হয়নি। স্কুল বাসা থেকে মাইল পাঁচেক দূরে। সামনে পিইসি পরীক্ষা। বিকেলের দিকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম, আজ রাতে পড়তে যাব না।
কিন্তু মা নাছোড়বান্দা। ভাত–তরকারি রান্না করে টিফিন রেডি। অজুহাত হিসেবে বললাম, ছাতা নেই। মিনিট তিনেক রাস্তা ভিজে গিয়ে নানুর বাসা থেকে ছাতা নিয়ে এল মা। বলল, ‘বাবা যা, সামনে তোর পরীক্ষা।’ পরে রাগ করে বলল, ‘তুই যদি আজকে পড়তে না যাস, রাতে ঘরে ঢুকতে পারবি না।’ রাগ করে আমি টিফিন ও টাকা রেখে শুধু ব্যাগ আর ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বুঝতে পারছিলাম মা ভিজে ভিজে অনেক দূর পর্যন্ত এসেছিল।
ব্যাগে ছয় টাকা ছিল। গাড়িতে করেই স্কুলে এলাম। খরচ হলো চার টাকা। পড়ছি আর ভাবছি মা কতটা নির্দয়! পেটে ইঁদুরদৌড় শুরু। খিদেয় একদম ভাঁজ হয়ে যাচ্ছিলাম। রাত আটটার দিকে স্যার ডেকে নিয়ে খেতে দিলেন। মা ফোন করে বলে দিয়েছিল, আমি না খেয়ে টিফিন ছাড়াই এসেছি।
বৃষ্টি না থামায় রাত ১০টার দিকে ব্যাগ গুছিয়ে সবাই একটা রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ভোরে উঠে বাসার দিকে রওনা হলাম। সকাল ১০টায় আবার স্কুল। সঙ্গে থাকা দুই টাকা দিয়ে কিছুটা পথ গাড়িতে এলাম, বাকিটা হেঁটে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই বাড়িতে গিয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলব না। পৌঁছে দরজায় নাড়া দিলাম। মুহূর্তেই দরজা খুলে দিল মা। তার মানে সে দরজার কাছেই মোড়ায় বসে ছিল! আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মায়ের সে কী কান্না, ‘বাবা, তুই ছাড়া আমার কে আছে! না পড়লে বড় অফিসার হবি কীভাবে?’ চোখমুখ ফোলা দেখে বুঝেছিলাম সে সারা রাত দরজার পাশে বসে কান্না করেছে এবং মুখে একটা দানা পর্যন্ত দেয়নি।
মায়ের এমন কঠোরতাই আজ আমাকে উচ্চশিক্ষার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে, ‘মা, তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি।’
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়