দীর্ঘশ্বাস

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

রুবি টাওয়ারের অষ্টম তলায় থাকে সাফওয়ান। ঠিক বিপরীত পাশেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা আঠারোতলার ভবন। সকালবেলা জানালা খুললেই ওদিকের বারান্দা দেখা যায়। সেই বারান্দায় প্রায়ই এক ছোট্ট ছেলেকে দেখে সাফওয়ান।

ছেলেটার নাম রুহিন। বয়স তিন কিংবা চার বছর হবে। ছোট্ট মুখে একরাশ কৌতূহল আর চোখে অদ্ভুত নিঃসঙ্গ আলো। সে বারান্দার চেয়ারে বসে খেলনা বিড়ালটাকে নিয়ে সারাক্ষণ কথা বলে,
‘এই, তুই এত কথা বলিস কেন? তোকে তো বলেছি চুপচাপ খেয়ে নে!’
কখনো আবার বিড়ালের দিকে তাকিয়ে মায়াভরা গলায় বলে,
‘তোমার মন খারাপ, বাবু? আসো না, তোমাকে খাইয়ে দিই।’
তারপরই কড়া স্বরে ধমক দেয়, ‘চুপ! কথা বলবি না কিন্তু! বললে মাইর দেব!’

প্রথম প্রথম এসব দেখে সাফওয়ানের হাসি পেত। ভাবত, ছোট শিশুরা এমনই। নিজের জগতে হারিয়ে থাকে। কিন্তু ধীরে ধীরে দৃশ্যটা কেমন ভারী হয়ে উঠল। প্রতিদিন সকালে কিংবা বিকেলে রুহিন একাই বারান্দায় থাকে। মা-বাবা দুজনই চাকরিজীবী। সকালেই বেরিয়ে যায়। রাতে ফেরে। মাঝেমধ্যে কাজের বুয়া এসে রুহিনকে খাইয়ে যায়। তারপর আবার একা রুহিন। সঙ্গী জড়বস্তু, খেলনা।

আরও পড়ুন

একদিন সাফওয়ান দূর থেকে দেখল, ছেলেটা বিড়ালটাকে সাবান দিয়ে গোসল করাচ্ছে। ছোট্ট হাতের ভেতর থেকে সাবানের ফেনা গড়িয়ে পড়ছে, আর সে গম্ভীর মুখে বিড়ালের গায়ে পানি ঢালছে। মুহূর্তটা যেন কারও অভাবের ছায়ায় ভিজে আছে।
হয়তো ওর মা এমন করেই গোসল করাত। হয়তো সেই স্মৃতিই এখন খেলনার মধ্যে ছুঁয়ে দেখে রুহিন।

সাফওয়ান এখন প্রতিদিনই বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। দৈনন্দিন কাজের ক্লান্তির ফাঁকে এই দৃশ্য যেন এক অদ্ভুত ভার রেখে যায় মনে। শিশুটির চোখে সে দেখতে পায় শহরের এক মুখহীন বেদনা। যেখানে আলো আছে কিন্তু উষ্ণতা নেই।
রুহিন কখনো বিড়ালটাকে পাশে রেখে চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। মলিন মুখে আকাশ দেখে। গলির নিচে অন্য শিশুরা খেলে। হইচই করে। রুহিন শুধু তাকিয়ে থাকে। হয়তো ভাবে, ‘ওরা কি আমার সঙ্গে খেলবে?’
কিন্তু তার মুখে সেই প্রশ্নের আওয়াজ ওঠে না। শুধু হালকা হাসে, তারপর ধীরে ধীরে মুখটা ঝুলে পড়ে।

আজ রুহিন বিড়ালটাকে বলছে—
‘খোকা বাবু, চলো না ঘুরতে যাই। আমাকে নিয়ে চলো, প্লিজ।’
তার কণ্ঠে আকুতি, অথচ সেই আকুতির উত্তর নেই। খেলনা বিড়াল তো কথা বলতে পারে না। ঘুরতে নিয়ে যেতে পারে না।
শহরটা কত অদ্ভুত! ভাবে সাফওয়ান। এখানে মানুষের সময় আছে ট্রাফিকে দাঁড়ানোর, মিটিংয়ে বসার, মানববন্ধন করার; কিন্তু সন্তানের সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলার সময় নেই। ঘর ভরা খেলনা অথচ খেলার সঙ্গী নেই।

রাতে সাফওয়ান বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ওপারের জানালায় আলো জ্বলছে। টেবিলের ওপর নিস্তব্ধ পড়ে আছে খেলনা বিড়ালটা। হয়তো রুহিন ঘুমিয়ে পড়েছে। স্বপ্নে হয়তো খেলছে কল্পনার বন্ধুদের সঙ্গে। এই শহর সত্যিই ভয়ংকর নিঃসঙ্গ। এখানে হাসির শব্দও মাঝেমধ্যে কাঁদে।

হালকা বাতাসে বারান্দার পর্দা নড়ছে। চারদিকে নিশুতি অন্ধকার। পশ্চিম আকাশে মেঘ জমেছে। ঘন কালো মেঘ। সাফওয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুমাতে গেল।

সভাপতি, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা