পিতৃতুল্য শিক্ষকের প্রতি কৃতজ্ঞতা
‘একজন শিক্ষক শুধু পাঠদান করেন না, তিনি শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে জ্ঞানের আলো জ্বেলে দেন, জীবনকে গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা দেন।’
২০১৭ সালের কথা। চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হলাম। এক নতুন অধ্যায়ের শুরু। অপরিচিত পরিবেশ, নতুন শিক্ষক, নতুন সহপাঠী—সবকিছুই এক নতুন দুনিয়ায় প্রবেশের অনুভূতি এনে দিয়েছিল। প্রতিদিন সকালে কলেজে আসার পথে রাস্তার দুই পাশে মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য মনের মধ্যে প্রশান্তির সুর তোলে। কলেজের সবুজে ঘেরা ক্যাম্পাস, ইতিহাসের গন্ধমাখা ভবন, গাছগাছালি—সব মিলিয়ে এক স্বপ্নরাজ্যের মতো লাগছিল।
ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ। এটি ছিল এক নান্দনিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান। চারপাশে সবুজ লতাপাতা, ছায়াঘেরা পরিবেশ, জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত প্রাঙ্গণ। বিভাগে প্রবেশ করার প্রথম দিন থেকেই অনুভব করলাম, এটি শুধুই একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি ভালোবাসার এক আশ্রয়স্থল।
নতুন ক্লাসের শুরুতেই পরিচয় হলো একজন গুণী শিক্ষকের সঙ্গে—অধ্যাপক মোহাম্মদ খোরশেদুল আলম স্যার। প্রথম দিনই স্যার এমন কিছু বলেছিলেন, যা আমাদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। একটি নতুন দিনের সূর্য ওঠার মতোই, স্যারের শিক্ষাও আমাদের জীবনে নতুন দিগন্তের সূচনা করে।
পরিচয় একজন শিক্ষকের সঙ্গে, যিনি হয়ে উঠলেন পথপ্রদর্শক। আমাদের বিভাগে অনেক কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ শিক্ষক ছিলেন। তাঁদের ভয়ে কখনো নিয়ম ভঙ্গ করার সাহস করিনি। কিন্তু সেই কঠোরতার আড়ালে ছিল অফুরন্ত ভালোবাসা। আমাদের সাবেক বিভাগীয় প্রধান মোহাম্মদ খোরশেদুল আলম স্যার সেই ভালোবাসার অন্যতম প্রতিচ্ছবি। তাঁর ব্যক্তিত্বই ছিল আমাদের শিক্ষার মূল ভিত্তি। তিনি যেমন ছিলেন স্নেহময়, তেমনই ছিলেন আদর্শবাদী।
স্যার ক্লাসে ঢুকেই সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘সেশন কত?’ আমরা একে অপরের দিকে তাকালাম। তখনো সেশন মনে রাখার গুরুত্ব পুরোপুরি বুঝিনি। স্যার তখন বললেন, ‘সেশন তো জরুরি বিষয়, এটা ভুলে গেলে কেমনে হবে?’ সেদিন হয়তো কথাটা অতটা গুরুত্ব দিয়ে শুনিনি। কিন্তু চার বছর পর উপলব্ধি করলাম, স্যার আমাদের জন্য কতটা দরদি ছিলেন। একজন শিক্ষক নন, পিতৃসমতুল্য অভিভাবক। স্যারের পাঠদানের ধরন ছিল একেবারে অনন্য। কঠোর শাসনের মধ্যেও ছিল অগাধ স্নেহ ও ভালোবাসা।
প্রতিদিন ক্লাসে এসে স্যার জিজ্ঞেস করতেন, ‘পত্রিকা পড়েছ সকালে?’ কেউ বলতাম পড়েছি, কেউ বলতাম পড়িনি। তখনই স্যার ধমকের সুরে বলতেন, ‘তোমরা কি ভালো জায়গায় যেতে চাও না? বিসিএস ক্যাডার হতে চাও না?’ কিন্তু ধমক দিয়ে থেমে যেতেন না, সঙ্গে সঙ্গেই আবার মিষ্টি হাসিতে বলতেন, ‘তোমরা তো সবচেয়ে ভালো মেয়ে, ভালো করে পড়াশোনা করো, প্রতিদিন পত্রিকা পড়ো, অন্য বই পড়ো—তাহলে জীবনের গতি ফিরবে!’
স্যারের এই কথাগুলো আজও কানে বাজে। সত্যিই তো, একজন শিক্ষার্থী যদি সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে চায়, তাহলে শুধু পাঠ্যবই নয়, জগতের সব ধরনের জ্ঞান অর্জন করাও জরুরি।
স্নেহময় কিছু মুহূর্ত, প্রতিদিন সকালে কলেজে গেলে স্যার আমাকে আলাদা করে ডাক দিতেন। বলতেন, ‘তানিয়া, এদিকে আসো। গাছের চারায় পানি দিতে পারবে?’ আমি উত্সাহ নিয়ে বলতাম, ‘অবশ্যই পারব, স্যার!’ তাড়াহুড়ো করে স্যারের কথামতো গাছে পানি দিতাম, আর স্যার মন খুলে হাসতেন। সেই হাসি যেন বাবার মতোই স্নেহে ভরা ছিল।
কখনো কখনো ক্লাসে কোনো পড়া না পারলে স্যার মজা করে বলতেন, ‘কানে ধরো!’ তখন হয়তো লজ্জা লাগত, কিন্তু বুঝতাম—এটা ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। স্যার আমাদের শাসন করতেন। তবে সেই শাসনে ছিল দায়িত্ব, ছিল ভালোবাসা।
একদিন ক্লাসে স্যার বললেন, ‘তোমরা কি শুধু পড়াশোনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে? নিজের চারপাশের জগৎ সম্পর্কে জানতে হবে, নিজেকে গড়ে তুলতে হবে একজন চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে!’ স্যারের প্রতিটি কথা ছিল আমাদের জন্য দিকনির্দেশনা, যা আজও জীবনের পথচলায় প্রেরণা জোগায়। স্যারের পড়ানো কেবল পাঠ্যবইয়ের সীমার মধ্যে ছিল না; তাঁর কথায়, তাঁর আচরণে ছিল একটি গভীর জীবনদর্শন, যা আমাদের পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে। যখন স্যার ক্লাসে ঢুকতেন, তাঁর উপস্থিতিতে পুরো পরিবেশ বদলে যেত। ওনার চোখে ছিল অদৃশ্য একটি আগুন—একটি আগ্রহ, একটি উজ্জীবন, যা আমাদেরও জাগিয়ে তুলত।
স্যারের যেকোনো কথাই ছিল একধরনের দিশারি, যা আমাদের কেবল শেখাতেই নয়, জীবনকে নতুন করে উপলব্ধি করতে সহায়তা করত। তিনি যখন বলতেন, ‘পাঠ্যবইয়ের বাইরেও এই পৃথিবী থেকে অনেক কিছু শিখতে হবে’। তখন আমরা বুঝতে পারতাম, তাঁর চাহিদা শুধু আমাদের একাডেমিক সফলতার জন্য নয়, বরং আমাদের ব্যক্তিত্ব গঠন এবং সমাজে নিজের জায়গা তৈরি করাও ছিল তাঁর শিক্ষার মূল লক্ষ্য। স্যারের এই চিন্তাভাবনা, তাঁর শাসন এবং তৎপরতা—এগুলোই আমাদের মনে গভীরভাবে প্রবাহিত হয়েছে। যেন আমরা তাঁর পাঠের মধ্য দিয়ে জীবনের এক নতুন অর্থ খুঁজে পেলাম।
স্যারের কথা কখনো কঠোর, কখনো কোমল; প্রতিটি শব্দই ছিল সত্যিকারভাবে আমাদের সঙ্গী। তাঁর শাসনে যে ভালোবাসা ছিল, তা কখনোই মনে কষ্ট দেয়নি; বরং আমাদের আরও দায়িত্বশীল করে তুলেছিল। স্যারের অনুপ্রেরণা ও শিক্ষা চিরকাল আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবে।
বিদায়ের দিন
স্যার পিআরএল (অবসরোত্তর ছুটি) নিয়ে কলেজ থেকে বিদায় নিলেন। সেই বিদায়ের দিন পুরো কলেজ যেন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, আমাদের অভিভাবককে হারাচ্ছি। বিদায় অনুষ্ঠানে আমরা সবাই স্মৃতিচারণা করছিলাম, শিক্ষকেরা কথা বলছিলেন, আর স্যার নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছিলেন। সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্তটি ছিল, যখন আমি স্যারকে মানপত্র প্রদান করি। স্যার যখন মানপত্র হাতে নিলেন, তখন তাঁর চোখেমুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ফুটে উঠল। তিনি গভীর আবেগ নিয়ে সেটি পড়লেন, তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘তোমাদের মাঝে কাটানো সময়গুলোই আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। আমি চাই তোমরা সবাই জীবনে এগিয়ে যাও, ভালো কিছু করো এবং মানুষ হিসেবে বড় হও।’ তখনই বুঝলাম, একজন শিক্ষক শুধু পাঠদান করেন না, তিনি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গঠনের মূল কারিগর।
একজন সত্যিকারের শিক্ষক চিরকাল বেঁচে থাকেন তাঁর শিক্ষায়। স্যার চলে গেছেন অবসরে, কিন্তু আমাদের মন থেকে কখনোই বিদায় নেবেন না। স্যারের প্রতিটি শিক্ষা, দিকনির্দেশনা, স্নেহময় শাসন—এসব চিরকাল আমাদের মনে থাকবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক কখনো শেষ হয় না। আমাদের কলেজ, আমাদের বিভাগ, আমাদের ক্যাম্পাস—এসব চিরকাল হৃদয়ে গেঁথে থাকবে।
কলেজ রোড, চকবাজার, চট্টগ্রাম।