প্রায় দুই মাস পর আজ শীতলক্ষ্যার তীরে একত্রিত হয়েছে কতগুলো কিশোর প্রাণ। তাদের খুব পছন্দের স্থান এটি। মাঝেমধ্যে এখানে বসে আড্ডার আসর। কিন্তু পরীক্ষার কারণে লম্বা সময় আসা হয়নি এদিকটায়।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে সেই কখন। সূর্য লাল হতে শুরু করেছে। পশ্চিম আকাশে বিদায়ের হাহাকার। নদীর বুক চিরে হুইসেল বাজিয়ে ধীরগতিতে চলছে মালবাহী বড় বড় জাহাজ। ঝুপঝাপ শব্দ তুলে নৌকা বাইছেন মাঝি। মৃদু হিমেল বাতাস পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। প্রকৃতির দিকে কারও মন নেই। সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ জাবেরের দিকে। চিরচেনা ভঙ্গিতে কথা বলে চলেছে সে। হঠাৎ ক্রিং ক্রিং শব্দ। সবার মনোযোগ ভেঙে যায়।
কথা থামিয়ে কিছুটা বিরক্ত হয়ে ফোন বের করে জাবের। স্ক্রিনে চোখ পড়তেই বিরক্তির লেশ কাটে। খানিকটা থমকে যায়। বড় মামার কল! কোনো দরকার ছাড়া তো সে ফোন দেয় না। দ্রুত রিসিভ করে। কথায় ব্যাঘাত ঘটার বিরক্তি ছড়িয়ে পড়ে সবার মধ্যে। তবে জাবেরের দিকে চেয়ে তাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে কিছু একটা হয়েছে। ফোন রাখতেই আরিফ কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘বন্ধু! কী হয়েছে?’ জাবের উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে, ‘তা তো বলেনি। তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে বলেছে শুধু। এখনি উঠতে হবে রে।’
জাবের হাঁটতে শুরু করে। সবাই তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার দিক। এত দিন পর একত্রিত হয়েও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে না পারায় কষ্ট লাগে জাবেরের। দ্রুত একটা রিকশা ইশারা করে সে। হাতের ইঙ্গিতে রিকশাওয়ালা বুঝে যায় নোয়াপাড়ার দিকে যেতে চাচ্ছে। সব সময় জাবের ভাড়া জিজ্ঞেস করে তবেই ওঠে। আজ তাড়াহুড়া করে জিজ্ঞেস করা হলো না।
জাবের ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। কিন্তু মাথায় যখন দুশ্চিন্তা থাকে তখন কেমন খিটখিটে হয়ে যায়। অল্পতেই রেগে যায়। রাস্তা দখল করে চলা ট্রাকটির চালকের ওপর এখন ভীষণ রাগ হচ্ছে। কিছু করার নেই। বাসায় কী হলো না হলো ভাবতে ভাবতে গন্তব্যে পৌঁছে যায় সে। রিকশাওয়ালাকে বলে, রিকশা থামান। রিকশাওয়ালা থামায় না। শোনেনি মনে হয়। জাবের আরও জোরে বলে। তা–ও থামায় না। রাগে ফুঁসে ওঠে সে। নোয়াপাড়ার শেষ প্রান্তে পৌঁছে রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করে, ‘মামা, আর কত দূর যাইবেন?’ জাবের এবার গলার আওয়াজ আরও বাড়িয়ে দেয়। রাগান্বিত কণ্ঠে বলে, ‘আপনার যত দূর ইচ্ছা নিয়ে যান। বললাম ওই মাদ্রাসার ওখানে থামতে। শুনলেন না। উল্টো আরও পাঁচ মিনিটের পথ সামনে চলে এসেছেন। এই ধরেন আপনার টাকা।’
রিকশা থেকে নেমে যায় সে। বিরক্তি-ভরা চেহারা ঘুরিয়ে পা বাড়ায় বাসার দিকে। রিকশাওয়ালা চায় রিকশা ঘুরিয়ে তাকে জায়গামতো নামিয়ে দিতে। কোনো ভ্রুক্ষেপ করে না জাবের। হঠাৎ রিকশাওয়ালার বিনয় বিগলিত কণ্ঠের ডাক তার চলার গতি থামিয়ে দেয়। ক্লান্ত চেহারার সরল লোকটা অসহায়ত্বের স্বরে বলে, ‘মামা, রাগ কইরেন না। আমি আসলে কানে কম শুনি। কেবল পেটের দায়ে রিকশা চালাইতে নামি। কামে বের না হইলে যে আমাগো খাবার জোটে না! অনেক সময় এমন ভুল হইয়া যায়। মাফ কইরা দিয়েন! রাগ কইরেন না মামা!!’
কথাগুলো শুনে বজ্রাহতের মতো সটান দাঁড়িয়ে থাকে জাবের। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানায়। বুঝতে পারে, অসহায় লোকটার সঙ্গে এমন আচরণ করা উচিত হয়নি।
বড়বাড়িয়া, চিতলমারী, বাগেরহাট