চারদিকে অথৈ জলরাশি। কোমর অবদি জলে ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হিজল, করচ, বরুন, জারুলসহ নানা প্রজাতির গাছ। এগুলো ডালপালা ছড়িয়ে সর্পিল আকৃতিতে উঠে গেছে ওপরের দিকে। মাথার ওপরে শামিয়ানার মতো ক্যানোপি তৈরি করেছে সবুজ ডালপালা। সেই প্রতিবিম্ব স্বচ্ছ পানিতে পড়ে পানির রং হয়েছে গাঢ় সবুজ।
বর্ষার মাঝামাঝিতে রাতারগুল বন এমনই নবযৌবনপ্রাপ্ত হয়। এটি বাংলাদেশের একমাত্র জলাবন। বর্ষাকালে এই জলাবন ২০ থেকে ৩০ ফুট পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে। বছরের বাকি সময় পানির উচ্চতা থাকে ১০ ফুটের মতো। পৃথিবীতে মিঠা পানির যে ২২টি জলাবন রয়েছে, তার মধ্যে রাতারগুল একটি। সিলেট জেলার গোয়াইনঘাটে অবস্থিত গোয়াইন নদীর তীরবর্তী এ বনের ৫০৪ একর এলাকাকে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার বন্য প্রাণী অভযারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে। প্রবেশপথেই রয়েছে মুর্তাগাছ। সিলেটের বিখ্যাত শীতলপাটি তৈরির প্রধান কাঁচামাল এটি। মুর্তাগাছকে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় বলে ‘রাতাগাছ’। সেই থেকেই এ বনের নামকরণ হয় রাতারগুল।
বনটির প্রধান আকর্ষণ বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ। প্রায় ৮০ প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে। প্রধান বৃক্ষ হিজল ও করচ। এ ছাড়া বরুন, জারুল, অর্জুন, ছাতিম, কদম, বট ইত্যাদি জলসহিষ্ণু গাছের সমাহার। নিচের স্তরে মুর্তা, বেতসহ নানা লতা-গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ বনের ঘন সবুজাভ ভাবকে আরও গাঢ় করে তুলেছে।
প্রচুর গাছপালা ও বিশাল জলাধারের কারণে বনটি এখন নানা প্রজাতির প্রাণীর বাসস্থান। বর্ষাকালে পানির পরিমাণ বাড়লে বিভিন্ন প্রজাতীর দেশীয় মাছের আনাগোনা দেখা যায়। গাছের শেকড়গুলো মাছের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মাছের আকর্ষণে উড়ে আসে নানা প্রজাতির শিকারি ও জলচর পাখি। মাছরাঙা, কানিবক, সাদাবক, পানকৌড়ি, চিল, ঘুঘু, বুলবুলি উল্লেখযোগ্য। হিজলের চিকন ডাল হতে ধৈর্যশীল মাছরাঙার ছোঁ মেরে মাছ শিকার করা বনের নৈমিত্তিক দৃশ্য।
সাপ, ব্যাঙ, টিকটিকি, গিরগিটিসহ নানা প্রজাতীর সরীসৃপও রয়েছে। স্থির জলরাশির ভাঁজ ভেঙে এঁকেবেঁকে ছুটে চলে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ। লতাগুল্মের সঙ্গে মিশে থাকা সবুজ রঙের বিষধর সাপকে অনেকেই সবুজ ডাল ভেবে ভুল করেন। মাঝেমধ্যেই দেখা যায় চঞ্চল প্রকৃতির কিছু বানর এ ডাল থেকে ও ডালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। কাঠবিড়ালি, বেজি, গেছো ব্যাঙদের আশ্রয়স্থল গাছের কোটর কিংবা ডালে।
শীতকালে বনের পরিবেশ সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। বেশির ভাগ জায়গায় পানি শুকিয়ে যায় এবং অবশিষ্ট পানিটুকু গিয়ে জমা হয় বন বিভাগের খননকৃত কৃত্তিম জলাশয়গুলোয়। জলের প্রাণীরাও সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। যে পথ বর্ষাকালে ছিপ নৌকা দিয়ে পার হতে হতো সেটি হাঁটাপথে রূপান্তর হয়। বনের অভ্যন্তরের প্রাণীবৈচিত্র্যেও আসে পরিবর্তন। গাছে আশ্রয় নেওয়া প্রাণীরা মাটিতে নেমে আসে। শিয়াল, বনবিড়াল, মেছোবাঘসহ নানা শিকারি প্রাণীর আনাগোনা বাড়ে তখন।
বন্ধু, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা