দীর্ঘক্ষণ চলতে পারত আলাপ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তানিম সাহেব উঠে দাঁড়ায়। নীরবতার মধ্যেও নেমে আসে বিষণ্নতার যতিচিহ্ন।
এই মফস্সলেও উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্নই বলা চলে। হাসপাতালের অপর পাশে কিছু উঠতি ডিসপেনসারি যেন ওষুধে ঠাসা কোনো বাক্স। ডক্টরস কোয়ার্টারে অন্য চিকিৎসদের সঙ্গে ডা. তানিমও থাকে। যদিও জনস্রোতের ঢাকা শহর ছেড়ে এখানটায় এসে হঠাৎ নীরব পরিবেশ তার দুটি ভ্রুকে কুঁচকে দিয়েছিল, তবু সে মানিয়ে নিয়েছে। অসংখ্য ফুলেল শোভা নিয়ে নিরিবিলি পার করছে জীবন। নিত্য রোগী আসছে-যাচ্ছে। কেউ তাকে চায়, আবার কেউ তার প্রতীক্ষায়।
আপনার নাম?
লাবণ্য।
লাবণ্য! সুন্দর। এই নামের বিশেষত্বটা জানেন?
জানি।
বলুন দেখি।
লাবণ্য আমাদের বরিশালের জীবনানন্দ দাশের স্ত্রী ছিল।
না, আমি আসলে সেটা জানতে চাইনি।
তবে? ও... আচ্ছা! আসলে, অমিতের সঙ্গে আমার নিজেকে ভাবতে ভালো লাগে না।
হা হা হা!
দীর্ঘক্ষণ চলতে পারত আলাপ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তানিম সাহেব উঠে দাঁড়ায়। নীরবতার মধ্যেও নেমে আসে বিষণ্নতার যতিচিহ্ন। ইতি টানি। আমিও উঠে আসি ঘোর থেকে।
কাল আসবেন, মিস লাবণ্য। আপনার আলট্রাসনো করতে হবে।
আসব। অস্ফুটে বলে বেরিয়ে আসি।
আমার গুমোট বাতাসহীন নির্জীব বাড়িটাকে বিরাট এক দস্যু মনে হয়। বদ্ধ ঘরে আলো জ্বালি না। সম্পদ বলতে কিছু গল্পের বই আর স্মৃতির বজরা ডায়েরি।
ফেব্রুয়ারি পাতা ঝরার মাস। চারদিকের ঝরা পাতা দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়। বিষণ্ন পাতাগুলো পদভারে মচমচ শব্দে ভেঙে চুরমার হয়। বিপন্ন হৃদয়ে গভীর রাতে হাসনাহেনা সুবাস ছড়ায়। আর মনে হয়, এই কিঞ্চিৎ দূরত্বও বিশাল। অথচ হাসনাহেনাকে আমরা দুজনই দেখি, তবে ভিন্ন চোখে। হয়তো তানিম সাহেব ঘ্রাণ নেওয়ারই ফুরসত পায় না। কিংবা তার চঞ্চল দৃষ্টি খুঁজে ফেরে অন্য কিছু, অন্য কাউকে... কে জানে!
বারবার এসে ফিরে ফিরে যাই। যদি একটু দেখা পাই। তার ছোট ছোট কথার ভাঙা টুকরাগুলো জমিয়ে আমি আবৃত্তিতে মহৎ কবিতা করে দিই। সে জানে না... জানবে না।
‘অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল
অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিল
মেহগনিছায়াঘন পল্লব ছিল অনেক,
অনেক কমলা রঙের রোদ ছিল
আর তুমি ছিলে।’
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করি। কোনটা কখন বলেছিল, কী বলেছিল, এমন সাতপাঁচ ভাবতে থাকি। যাওয়া-আসা করি। কখনো ভুল করে দেখা হয়, কখনো হয় না। দৈবাৎ দেখা হলে মাথা নাড়িয়ে তার প্রশ্ন, ‘ভালো আছেন?’ উত্তর দেওয়ার অবকাশ না দিয়েই দ্রুতগতিতে চেম্বারে ঢুকে পড়ে সে।
কালো-সাদা দাবা বোর্ডের মতো হয়ে যাচ্ছে জীবনটা। আলো পেতে হলে সাদা বিশপের মতো কোনাকুনি চলতে হয়। কিন্তু এই পথচলায় না আছে আনন্দ, না আছে দুঃখ। কেমন যেন সবকিছুতে বোহেমিয়ান ভাব। এই আছে, এই নেই।
‘আপনার আলট্রাসনোর রিপোর্ট ভালো। তবে খাদ্যাভাস পরিবর্তন করতে হবে। বাঁচতে হবে, কেমন?’
এই এক বাক্যেই আমার তাল কেটে গেল। চশমার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায় কান্না। মনে হয়, এই অসীম ধরাতলে কেবল দুঃখটাই ধ্রুব। বাঁচতে হবে! কিসের জন্য? কেন?
উত্তর দিলাম না। পুরোনো ঘড়ির মতোই মাথাটা শ্লথ হয়ে আসে।
একগাদা ওষুধ এনে খাচ্ছি। কীসব বিদ্ঘুটে নামের ওষুধ। খেতে মনে থাকে না। কোথায় রেখেছি, তা–ও মনে নেই। বন্ধুদের সঙ্গে হাসপাতালে প্রায়ই যেতে হয়; কারণে-অকারণে। সেদিন মাখন রঙের এক শার্টে তার সঙ্গে দেখা। একপলক দেখেই হেসে ফেলি। তারপর তার অনন্ত জিজ্ঞাসা, ‘ভালো আছেন?’
সূর্য ডুবছে। এই ম্লান আলোয় হাসনাহেনা নীরব। পাখিরা ক্লান্ত, নীড়ে ফিরছে। আমি দাঁড়িয়ে বোবা প্রকৃতিতে বিপন্ন কিছু হন্যে হয়ে খুঁজছি। ওদিকে তানিম সাহেব একধ্যানে প্রেসক্রিপশন লিখছে।
চারদিকের এত ডাকাডাকি আর চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে সেই যেন অসপর্শক এক আগন্তুক।
হয়তো কোনো এক সন্ধ্যায় তার সঙ্গে আর দেখা হবে না। আমার সব অনুভূতি জড়ো হয়ে বোবা কান্নায় রূপ নেয়। ঘরের দেয়ালে মৃত্যু, বাইরে সে।
চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাবি, সে কি চাঁদ দেখে? হাসনাহেনার সুবাসে বিমুগ্ধ গোলাপি-নীল চাঁদ? নাকি আলো-ছায়ার খেলায় বারবার নিজেকে দেখে ভিন্ন ভিন্ন রঙে! উদ্ভট কিছু কল্পনা মিলে তাকে নিয়ে আমার মস্তিষ্ক অদ্ভুত এক রহস্য তৈরি করে। ভয় হয়, আমাদের হয়তো আর দেখা হবে না, কথা হবে না। বুঝতে পারি, আমার এসব আবেগ অনেক পলকা।
সে হেঁটে যায়। দৃপ্ত পায়ের ছাপ রেখে যায় সর্বত্র। তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিপন্ন হয়ে যাই আমি। বাস্তবতার অতীত একগুচ্ছ ছেঁড়া গল্প হয়ে যায়।
গরম তার ক্লান্ত ফরসা মুখটাকে করে দেয় লালচে। কালপুরুষ-সপ্তর্ষিমণ্ডল ছাড়িয়ে সে হয়ে যায় মেঘের মতো। ধরা দিয়েই আছে, কিন্তু কিছুতেই ধরা দেবে না। অথচ আমার বিলুপ্ত স্বপ্ন প্রসেয়ত যুদ্ধ করে। ভুলক্রমে দেখা পেতে চায়। হয়তো দেখা হবে সেই আগের মতো! প্রেসক্রিপশনে বুঁদ হয়ে থাকা চিকিৎসক দৈবাৎ আমার পাশে দাঁড়িয়ে আবার প্রশ্ন করবে, ‘ভালো আছেন?’
আর আমি অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে তার মৃদু স্পর্শ পেয়ে মুচকি হাসব। জানি, তাকে কখনোই পাওয়া হবে না। এদিকটা অন্ধকার। আলোকিত কেউ আঁধার চায় না। কেউই চায় না।
আলোহীন জানালায় ফুটে থাকা হাসনাহেনার ডালে তার স্পর্শ খুঁজি প্রসেয়ত। হয়তো কোনো একদিন মনভুলে পরম অভ্যস্ততায় সে স্পর্শ করেছিল, হয়তো খোঁজ নিয়েছিল সে কারও এবং আমিই সহসা তাকে একদিন প্রশ্ন করব, ‘ভালো আছেন, ডাক্তার?’
শিক্ষার্থী, শহিদ বীর উত্তম লে. আনোয়ার গার্লস কলেজ, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট