অন্তর্মুখী নয়, বহির্মুখীও নয়

সমাজে চলতে গিয়ে ‘অ্যাম্বিভার্ট’ মানুষদের সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। চারপাশের মানুষজনও বুঝতে পারে না এদের।প্রতীকী ছবি
এমন মানুষেরা একই সঙ্গে হইহুল্লোড় করে, আড্ডা দেয়, মজা করে; আবার সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একা করেও রাখে।

মানুষ নানা রহস্যে বেষ্টিত প্রাণী; যার আদল দেখে অন্তরমহলের অবস্থা আঁচ করা মুশকিল। শব্দটিকে ‘মুশকিল’ না বলে, ‘অসাধ্য’ বললেই এর প্রতি সুবিচার করা হবে। পৃথিবীতে মানুষের আদলগত ভিন্নতা যেমন আছে, তেমনই প্রত্যেক মানুষের ভেতর বাস করা মানুষটির মধ্যেও রয়েছে নানা পার্থক্য। মানুষের মস্তিষ্ক যেন এলোমেলো সূক্ষ্ম সুতার বুনন। যার জট খোলা জড়িয়ে-পেঁচিয়ে কুণ্ডলি পাকিয়ে যাওয়া সুতার জট খোলার চেয়ে কঠিন।

পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে, যারা খুব মিশুক আর আমুদে। সারাক্ষণ হইহুল্লোড় ও আনন্দে মেতে থাকে। এসব মানুষের বন্ধুর সংখ্যা আকাশের নক্ষত্ররাজির মতো। সেই মহলে বেশ দাপিয়েই বেড়ায় এরা। খুব সহজে মিশে গিয়ে, সবাইকে নিজের করে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে এদের। বিজ্ঞানের ভাষায় এই স্বভাবের মানুষদের বলে ‘এক্সট্রোভার্ট’ বা ‘বহির্মুখী’। আবার একেবারেই উল্টো স্বভাবেরও কিছু মানুষ আছে, যারা নিজের মতো একা থাকতে ভালোবাসে। কারও সঙ্গে ঠিক মিশে উঠতে পারে না। সারাক্ষণ নিজের জগৎ নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এদের বলা হয় ‘ইন্ট্রোভার্ট’ বা ‘অন্তর্মুখী’।

এই দুই শ্রেণির মাঝামাঝি কিছু মানুষ আছে, যারা কখনো খুব মিশুক আবার কখনো গম্ভীর। এমন মানুষেরা একই সঙ্গে হইহুল্লোড় করে, আড্ডা দেয়, মজা করে; আবার সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একা করেও রাখে। এদের বলা হয় ‘অ্যাম্বিভার্ট’। সমাজে চলতে গিয়ে এই ধরনের মানুষদের সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। চারপাশের মানুষজনও বুঝতে পারে না এদের।

কিছুক্ষণ আগে হইহুল্লোড় করে বেড়ানো মানুষটি যদি হঠাৎ সেখান থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে চুপ হয়ে যায় বা একা থাকতে চায়, তাহলে কেউ বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নেবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কেউ এটাও বুঝতে চায় না যে এখানে তাদের কোনো হাত নেই। খুব সহজেই এরা সবার সঙ্গে মিশে গেলেও এই সমস্যার কারণে; এদের খুব বেশি বন্ধু থাকে না। গুটিকয়েক বন্ধু নিয়েই এদের জীবনের অধ্যায় শেষ হয়।

‘অ্যম্বিভার্টরা’ প্রচণ্ড অভিমানী ও আবেগপ্রবণ হয়। এদের বাইরের আচরণ দেখে ভেতরের অবস্থা আন্দাজ করা যায় না। ভেতরে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস বয়ে গেলেও বাইরে থেকে মনে হয় ঝলমলে রোদ্দুরময় দিন। এরা খারাপ সময়েও ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে বলতে পারে, ‘ভালো আছি’। নিজের বিষাদ চাপা দিয়ে, অন্যের মনের চিকিৎসা দিতে ব্যতিব্যস্ত থাকে এরা। এসব মানুষ খুব চাপা স্বভাবের; দাঁত কামড়ে সব সহ্য করে। নিজ থেকে না বলা পর্যন্ত আপনি এদের ভেতরের খবর জানতে পারবেন না। এরা খুব একটা নিজের ভেতরের খবর বলে না। বলে না বললে ভুল হবে। আসলে বলার মতো কাউকে খুঁজেই পায় না। কারণ, এদের বন্ধুর সংখ্যা খুব সীমিত। জীবনে চলার পথের বাঁকে বাঁকে কত মানুষের সঙ্গে এদের পরিচয় হয়, কিন্তু কেউ ঠিক ভেতরঘরের মানুষ হয়ে উঠতে পারে না।

এসব মানুষের নিজেদের একান্ত জগৎ থাকে, যার চারপাশে অদৃশ্য এক পাঁচিল তুলে রাখে এরা। কেউ চাইলেই পাঁচিল টপকে সেই জগতে প্রবেশ করতে পারে না। ভালোবাসা আর বিশ্বাস হচ্ছে সেই জগতে প্রবেশের অনুমতিপত্র। যদি কেউ একবার প্রবেশ করার অনুমতি পায়, তাহলে অবাধ বিচরণ করতে পারে সেখানে। এরা মানুষকে বারবার বিশ্বাস করে, বারবার ঠকে। এদের ঠকানো খুব সহজ। একটু মায়া জড়িয়ে কথা বললেই পেছনের ঝুমবর্ষা ভুলে গিয়ে, পা বাড়ায় নতুন ভুলের দিকে।

এত কিছুর পরও এদের কোনো অভিযোগ-অনুযোগ নেই। এরা এদের মতোই থাকে। তবে মাঝেমধ্যে এসব মানুষ খুব একাকিত্ব অনুভব করে। দুদণ্ড কথা বলার জন্য অসহায় চোখ কাউকে খুঁজে বেড়ায়। খুব করে চায়, অদৃশ্য পাঁচিল টপকে এদের জগতে কেউ ঢুকে পড়ুক, একটানে খুলে ফেলুক একাকিত্বের চাদর।

ব্লক-জি, বনশ্রী, ঢাকা