চট্টগ্রামের পটিয়া সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে করল গ্রাম পেরিয়ে গেলেই টেগরপুনি গ্রাম। মুন্সেফ বাজার অথবা সিও অফিস এলাকা থেকে ২০-২৫ মিনিট সময় লাগে। পটিয়া বাইপাস সড়ক দিয়ে গেলে সময় কিছুটা কম লাগে। শ্রাবণের শেষে গিয়েছিলাম টেগরপুনি গ্রামে। প্রকৃতির তখন নতুন সাজ। টেগরপুনি যাওয়ার পথে চোখে পড়ে জলদাসপাড়া। জলদাসপাড়ায় পটিয়ার কালের সাক্ষী করল সুমঙ্গল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলটি সুমঙ্গল নামে এক বৌদ্ধ ভিক্ষু ১৮৫৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন।
মুক্তিযোদ্ধা সুনীল কান্তি জলদাসের স্মৃতি বিজড়িত করল জলদাসপাড়া। বৌদ্ধমন্দিরের পাশে অশ্বত্থ, পাকুড়, বটগাছে নানা জাতের পাখিদের কলতান। রাস্তার পাশে শত বছরের গাছটি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তায় ঝরে পড়া শুকনা পাতার ওপর পায়ে পাড়া দেওয়াতে পাতার মর্মর ধ্বনি কানে এল। বটগাছের চারদিকে লাল কাপড় ও সুতা দিয়ে বৃক্ষের চারপাশে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। গাছের নিচে মোমবাতির মোম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বৌদ্ধধর্মালম্বীরা পূজা দিয়ে গেছে। বৃক্ষের গায়ে অনেক পেরেক ছিল। গাছ কথা বলতে জানলে হয়তো বারণ করত আমার গায়ে পেরেক মারবেন না। গাছের মূলের কাছে আগুন দেবেন না। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বটবৃক্ষের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।
বৃক্ষের যে প্রাণশক্তি আছে মানুষের জীবনের সঙ্গে কত-না মিল। এজন্য বোধ হয় ‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণে’ লেখক আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘ফুল ফোটানো সহজ কথা নয়, শূন্য থেকে মূর্ত করা সৃষ্টির বিস্ময়। পারে সে জন ভেতর থেকে ফোটার স্বভাব যার, ফালতু লোকের ভাগ্যে থাকে বন্ধ্যা অহংকার। বৃক্ষের ভেতর যে সরল জীবনপ্রবাহ স্পন্দিত হয়, তার সঙ্গে মানুষের হৃৎস্পন্দনের অবশ্যই একটা মিল আছে। প্রকৃতিগতভাবে উভয় একই বস্তু। কিন্তু তারতম্য শক্তি হচ্ছে গতিশীলতায়। একজন পুরুষ একজন নারীর সঙ্গে যেভাবে সম্পর্ক নির্মাণ করে, সেভাবে একজন মানুষ একটি বৃক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু মানুষ যিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে পারেন, বৃক্ষেরও একটি জীবন্ত সত্তা রয়েছে, অন্য যেকোনো প্রাণীর মতো।’
মেঠোপথ পেরিয়ে যখন টেগরপুনি গেলাম তখন বেলা এগারোটা। সঙ্গে ছিলেন টেগরপুনি গ্রামের শাওন বড়ুয়া। ধানিজমির আইল দিয়ে যাওয়ার সময় পায়ে কাদা মেখে একাকার। সরু বাঁকখালী খাল আঁকাবাঁকা খালটি যেন আমাদের ছোট নদী। কয়েকজন জলদাস মাছ ধরতে ব্যস্ত। এক কিশোরীকে দেখলাম শালুক কুড়োচ্ছে। আমিও নেমে যেতে চাইলাম, শাওন থামাল। পানিতে জোঁক আছে।
সবুজ অরণ্য ঘেরা গ্রাম টেগরপুনি। দিঘি, শানবাঁধানো ঘাট, বট, বকুল, তমাল নানা রকমের বৃক্ষরাজি। কোনোটা ঔষধি, কোনো ফলদ। পুকুর ঘাটে খোদাই করে লেখা অলংকার স্নান তীর্থ ঘাট। কয়েকজন বৌদ্ধ লাল সালুকাপড় পরে পুণ্য লাভের জন্য ঐ ঘাটে স্নান করছে। দিঘির পশ্চিমে বুড়া গোঁসাই বৌদ্ধমন্দির। কয়েকটা সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে মন্দিরে ঢুকে পড়লাম।
মন্দিরে পূজায় মগ্ন কয়েকজন নবদম্পতি। ভিক্ষু তাঁদের কী জানি মন্ত্রও দিচ্ছে। বুড়া গোঁসাই মূর্তিটি পুড়ো মাথা সোনালি রঙের পাতা দিয়ে মোড়া। দেখলে মনে হবে স্বর্ণের মূর্তি। ধ্যানমগ্ন বসে আছে। ভিক্ষুর কাছে জানতে পারলাম, এ মন্দিরের ইতিহাস। তিনি জানালেন, এই এলাকাটা ছিল পাহাড় অরণ্য ঘেরা। ভয়ে কেউ যেত না। সাহস করে খোয়াইল্ল্যা (হলুদ জাতীয় উদ্ভিদ, যা দিয়ে ময়দা তৈরি হয়) তুলতে যেত। একদিন বাকখালী গ্রামের শ্রী ধনরঞ্জন বড়ুয়ার স্ত্রী নীলাকুমারী ঐ স্থান থেকে খোয়াইল্ল্যা তোলার জন্য কোদাল চালিয়ে মাটি খনন করে। টের পান প্রচণ্ড আঘাতের শব্দ। যেখানে কোপ দিয়েছিলেন সেখানে হঠাৎ লাল রক্ত বের হয়। নীলাকুমারী ভয়ে অস্থির হয়ে দৌড়ে বাড়ি ফিরে আসেন। সেদিন রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন বুড়া গোঁসাইকে। বুড়া গোঁসাই তাঁকে স্বপ্নে বলেন, ‘আমি ওই জায়গায় অধিষ্ঠিত আছি। তোমরা আমাকে উঠাও।’ তিনি ব্যাপারটা তাঁরই ভগ্নীপুত্র হারাধন মহাস্থবিরকে জানান। হারাধান মহাস্থবিরের সহযোগিতায় ঐ জায়গাটা খনন করতে গিয়ে দেখেন, স্বপ্নে দেখা মূর্তিটি বসে আছে। এভাবে প্রতিষ্ঠা পায় বুড়া গোঁসাই বৌদ্ধমন্দির।
টেগরপুনি গ্রামে বহু দূরদূরান্ত থেকে বৌদ্ধধর্মালম্বীরা, এমনকি বিদেশি পর্যটকরাও প্রার্থনা করতে আসেন। পূজা দিয়ে যান। টেগরপুনিতে চারটি মন্দির আছে। বুড়া গোঁসাই বৌদ্ধমন্দির, বৈজয়ন্তী বিহার, সাধারণ মৈত্রী বিহার, সংঘরাজ শাক্যমুনি বৌদ্ধবিহার। প্রতিবছর মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে এখানে মেলা বসে। যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে মেলা; অনেকে ঠ্যাঁ পাইরের মেলা বলে (টেগরপুনি পুকুরের মেলা)। টেগরপুনির ঐতিহ্যবাহী এ মেলা সপ্তাহব্যাপী হয়ে থাকে। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী পুণ্য লাভের আশায় মেলায় আসেন। প্রতিবছর এখানে কঠিন চীবরদান অনুষ্ঠান হয়। বৌদ্ধদের একটা তীর্থ স্থানও বলা যায়। মন্দিরের দেওয়ালে শিল্পী প্রমোদ বড়ুয়ার বেশ কয়েকটি চিত্রকর্ম চোখে পড়ল। মহামায়ার স্বপ্ন, সিদ্ধার্থের জন্ম, জরামরণ দর্শন, পঞ্চ বর্গীয় শিষ্য, সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ, কঠোর সাধনা, মহা পরিনির্বাণ ইত্যাদি।
অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষুরা প্রার্থনা করার জন্য থেকে যায়। লোহাগাড়া থানার পুটি বিলা গ্রামের বিহারাধ্যক্ষ শ্রীমৎ সুবিতানন্দ ভিক্ষু চৌদ্দ বৎসর ধরে এখানে আছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে খুব ভালো লাগে। বাকি জীবনটা এখানেই কাটিয়ে দিব।’
গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চাইলে শ্রীমৎ সুবিতানন্দ ভিক্ষু বলেন, ‘৬২৫ খ্রিঃ পূর্ব নেপালের লুম্বিনী কাননে সিদ্ধার্থের জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম রাজা শুদ্ধধন, মা মায়া দেবী। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে সিদ্ধার্থ মামাতো বোন গোপা দেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। রাহুল নামের তাঁর এক ছেলে ছিল। একসময় সিদ্ধার্থ স্ত্রী-পুত্র সংসারজীবন সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে কঠোর সাধনার মাধ্যমে বুদ্ধত্ব লাভ করেন। ৪৫ বছর বয়সে তিনি ধর্মপ্রচার শুরু করেন। বৈশাখী পূর্ণিমা বৌদ্ধদের স্মৃতি বিজড়িত এক মহান পূর্ণিমা। এ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে গৌতম বুদ্ধের জন্ম, বৌদ্ধত্ব লাভ ও মহানির্বাণ। শ্রী গৌতম বৌদ্ধ জন্মদিনকে ঘিরে বুদ্ধদের প্রধান উৎসব বৌদ্ধপূর্ণিমা বা বৈশাখী পূর্ণিমার উৎসব আয়োজন করা হয়। পুণ্যলাভের আশায় তারা ফানুস ওড়ায়।’
বৌদ্ধরা কর্মে বিশ্বাসী, কর্মই এদের ধর্ম। কর্মই তাদের সেবা। সর্বজনের কল্যাণে তারা নিবেদিত। জীবের প্রতি তাদের অসম ধর্মবোধ। সবাই একত্রিত হয় মানবের মুক্তির জন্য। টেগরপুনির এই ঐতিহ্যবাহী মন্দির আমাকেও ভাবিয়ে তুলেছিল, আমি কতটুকু পারি মানুষের পাশে দাঁড়াতে—কল্যাণে। টেগরপুনি গ্রাম থেকে যখন ফিরছিলাম, সূর্য তখন পশ্চিমা আকাশে হেলছিল।
উপদেষ্টা, পটিয়া বন্ধুসভা