যে কারণে এ বছরও মেসির হাতেই ওঠা উচিত ব্যালন ডি’অর

বিশ্বকাপ জিতে ক্যারিয়ারের একমাত্র অপ্রাপ্তি ঘুচিয়েছেন মেসিছবি : ফিফা

‘সে আমাদের জন্য অনেক বড় খেলোয়াড়। তাঁকে কোচিং করানো আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। সতীর্থদের মধ্যে সে যা কিছু যেভাবে (উৎসাহ, অনুপ্রেরণা) ছড়িয়ে দেয়, তা অবিশ্বাস্য—এমন কিছু যা আমি আগে কখনো দেখিনি।’ ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল জয়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় লিওনেল মেসি সম্পর্কে এভাবেই অনুভূতি ব্যক্ত করেন আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি।

আরও একটি ব্যালন ডি’অর পুরস্কার সন্নিকটে। আগামী ৩০ অক্টোবর এটি অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে আলোচনায় কার হাতে উঠতে যাচ্ছে ফুটবলের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত এই স্বীকৃতি। এখনো ফ্রান্স ফুটবল সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ না করলেও ধারণা করা হচ্ছে, লিওনেল মেসি অথবা আর্লিং হলান্ডের মধ্যে যেকোনো একজনের হাতে উঠবে পুরস্কারটি। এই দুজনের মধ্যে কে বেশি দাবিদার, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে। তবে আলোচনা করব মেসির হাতেই কেন ওঠা উচিত এবারের ব্যালন ডি’অর?

বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে মেসি, দি মারিয়া, দিবালাদের বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস
ছবি : ফিফা

অধরা বিশ্বকাপ জয়
বার্সেলোনায় থাকাকালীন ২১ বছরের অবিশ্বাস্য ক্যারিয়ারে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। জিতেছেন ৭টি ব্যালন ডি’অর। যা ইতিহাসে সর্বাধিক। ক্লাবের হয়ে লা লিগা, চ্যাম্পিয়নস লিগসহ অসংখ্য শিরোপা জয় করেন। এর বাইরে ফিফা বর্ষসেরা, উয়েফা বর্ষসেরা, গোল্ডেন বুট, গোল্ডেন বলসহ একাধিক ব্যক্তিগত পুরস্কারও অর্জন করেন লিওনেল মেসি। তবু তাঁকে সর্বকালের সেরা বলতে অনেকের আপত্তি ছিল। এসব অর্জন সবই ক্লাবে পারফরম্যান্সের সুবাধে। জাতীয় দলের হয়ে আন্তর্জাতিক শিরোপার শোকেস যে তখনো শূন্য!

ইতিহাসের সেরা ফুটবলার হতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সঙ্গে চলা বিতর্কের অবসান ঘটানো কিংবা স্বদেশি কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনার ছায়া হতে বেরিয়ে আসার জন্য হলেও মেসির একটি বিশ্বকাপ জয় বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া নিজেকে এত উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে সেটিকে পরিপূর্ণতা দিতে হলেও যে বড় কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপা দরকার! কেবল মেসি কিংবা তাঁর সমর্থকেরাই নন, প্রকৃতিও যেন এটাই চাচ্ছিল। তাই তো মাত্র দেড় বছরের মধ্যে ক্যারিয়ারের সব অপূর্ণতা ঘুচে যায় মেসির। প্রথমে কোপা আমেরিকা, এরপর লা ফিলাসামিয়া এবং সর্বশেষে অধরা বিশ্বকাপ জয়। সেই সঙ্গে অবসান ঘটালেন সর্বকালের সেরা হওয়া নিয়ে বিতর্কেরও।

আর্জেন্টিনা অধিনায়ক লিওনেল মেসি
ছবি: এএফপি

বিশ্বকাপে নেতৃত্ব ও ব্যবধান গড়ে দেওয়া পারফরম্যান্স
কাতারে মেসি কেবল বিশ্বকাপই জয় করেননি, ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স ও অসাধারণ নেতৃত্ব দিয়ে মুগ্ধ করেছেন পুরো বিশ্বকে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭টি গোল করেন; যা গোল্ডেন বুট জয় করা কিলিয়ান এমবাপ্পে (৮টি) থেকে মাত্র একটি কম। টুর্নামেন্টে যৌথভাবে সর্বোচ্চ অ্যাসিস্ট (৩টি) এবং গুরুত্বপূর্ণ পাসও (২১টি) সাবেক বার্সেলোনা ও পিএসজি তারকার দখলে। পাশাপাশি রেকর্ড টার্গেট শটও (১৩টি) নিজের করে নেন। এ ছাড়া ইতিহাসের প্রথম ফুটবলার হিসেবে কোনো একক বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব, দ্বিতীয় রাউন্ড, কোয়াটার ফাইনাল, সেমিফাইনাল ও ফাইনালে গোল করার অনন্য রেকর্ড গড়েন তিনি। এটি করতে গিয়ে মেসি আরও একটি রেকর্ড গড়েন—এক টুর্নামেন্টে সর্বাধিক পাঁচটি ম্যাচসেরা পুরস্কার!

এর বাইরে ইতিহাসের প্রথম ও একমাত্র ফুটবলার হিসেবে দুটি বিশ্বকাপে গোল্ডেন বল জেতার রেকর্ড গড়েন এলএমটেন। প্রথমটি জিতেছিলেন ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে।

এ তো গেল ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের কথা। এবার আসা যাক কাতার বিশ্বকাপে মেসির নেতৃত্ব প্রসঙ্গে। কাতারে তিনি কেবল নিজের নেতৃত্ব গুণাবলিকেই শাণিত করেননি, দলের প্রত্যেকটি খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্স গ্রাফও অনেক ওপরে তুলেছেন। যেমনটা তিনি ২০২১ সালের কোপা আমেরিকায় দেখিয়েছিলেন। একজন মহান নেতার মধ্যে যত গুণাবলি থাকা দরকার, এর সবই কাতারে মেসির মধ্যে দেখা গেছে। একেবারে প্রথম ম্যাচ থেকে ফাইনাল পর্যন্ত দলকে সামনে থেকে পথ দেখিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ঝলক দেখা গেছে কোয়াটার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে।

মেসি–আলভারেজ জাদুতে অনন্য আর্জেন্টিনা
ছবি: রয়টার্স

ওই ম্যাচে টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনা জয় পেলেও তার আগে ঘটে যায় অনেক নাটকীয়তা। যেখানে সতীর্থদের আগলে রাখতে মেসিকে অগ্নিমূর্তিতে দেখা যায়। তাঁর এমন রূপ এর আগে আর কেউ কখনো দেখেছে কি না, তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর! পরবর্তী সময়ে সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টাইন অধিনায়ক এতটাই দুর্দান্ত পারফরম্যান্স প্রদর্শন করেন যে ক্রোয়েট মিডফিল্ডার লুকা মদরিচ ম্যাচ শেষে বলেন, ‘আশা করছি মেসি বিশ্বকাপ জিতবে। সে ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় এবং এটা সে ডিজার্ভ করে।’ এর আগে দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচ শেষে অস্ট্রেলিয়ার মিডফিল্ডার কিয়ানু ব্যাকাস মেসি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘মাঠে সে দেখতে অনেকটা মোমের মূর্তির মতো। সত্যি বলতে, এটা বলে বোঝানো সম্ভব নয় যে সে কতটা ভালো।’ মোটকথা ২০২২ বিশ্বকাপ পুরোটাই ছিল মেসির টুর্নামেন্ট।

ক্লাবে পারফরম্যান্স
পিএসজির হয়ে ২০২২-২৩ মৌসুমটা ভালো-মন্দ মিলিয়ে কেটেছে আর্জেন্টাইন সুপারস্টারের। বিশ্বকাপের আগে প্রথম হাফে ছিলেন অবিশ্বাস্য! নেইমার ও এমবাপ্পের সঙ্গে মিলে প্রতিপক্ষের ডিফেন্সে একের পর এক ত্রাস ছড়িয়েছেন। মনে হচ্ছিল এবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জয় করা তাঁদের কেবল সময়ের ব্যাপার! ওই সময়ের মধ্যে সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে নিজে ১২টি গোল করেন এবং সতীর্থদের দিয়ে করান আরও ১৪টি গোল। যা ইউরোপের শীর্ষ পাঁচটি লিগের মধ্যে সর্বোচ্চ। কিন্তু বিশ্বকাপের পর পিএসজির মোমেন্টাম হারিয়ে যায়। কোনো রকমে লিগ শিরোপা জিতলেও চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলো থেকে বাদ এবং নেইমারের ইনজুরি দলের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়।

মেসির পিএসজি অধ্যায় ভালো কাটেনি
ছবি: রয়টার্স

এরপরও মৌসুম শেষে সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে মেসির নামের পাশে ৪১ ম্যাচে ২১ গোল ও ২০ অ্যাসিস্ট। ৩৬ বছর বয়সী একজন ফুটবলারের জন্য যা অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স। গোলে অবদানের দিক দিয়ে ইউরোপের শীর্ষ লিগগুলোতে তার আগে রয়েছে কেবল লিভারপুলের মোহাম্মদ সালাহ, পিএসজির কিলিয়ান এমবাপ্পে ও ম্যানচেস্টার সিটির আর্লিং হলান্ড।

ব্যালন ডি’অর জয়ে হলান্ড যে কারণে ফেবারিট নয়
মেসি ছাড়া একমাত্র যে খেলোয়াড়টি ব্যালন ডি’অর জিততে পারেন, তিনি আর্লিং হলান্ড। নরওয়েজিয়ান এই স্ট্রাইকার ২০২২-২৩ মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগে ৩৬ গোল করেছেন। যা এক মৌসুমে লিগটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এ ছাড়া চ্যাম্পিয়নস লিগে ১২ গোল, এফএ কাপে ৩টি এবং কারাবো কাপে ১টি গোল করেন। ম্যানচেস্টার সিটির ট্রেবল জয়ে তাঁর অবদানই সবচেয়ে বেশি। এই পারফরম্যান্সের সুবাদে এরই মধ্যে পিএফএ বর্ষসেরা ফুটবলার ও উয়েফা বর্ষসেরা ফুটবলারের স্বীকৃতি পেয়েছেন।

চ্যাম্পিয়নস লিগের ট্রফি হাতে আর্লিং হলান্ড
সিটি টুইটার

কিন্তু এটা বিশ্বকাপের মৌসুম। যেখানে ব্যালন ডি’অর পুরস্কারে টুর্নামেন্টটির অবদান অনেকাংশেই থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৮ বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার লুকা মদরিচ, ২০১৪ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি, ২০০৬ বিশ্বকাপে ইতালির ফাবিও ক্যানবেরা, ২০০২ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের রোনালদো, ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের জিনেদিন জিদান। কেবল ২০১০ বিশ্বকাপে ব্যতিক্রম ঘটেছে। আর নরওয়ে ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে খেলা হয়নি হলান্ডের।

অন্যদিকে মেসি একজন পূর্ণাঙ্গ ফুটবলার; যিনি ম্যাচে একাই পার্থক্য গড়ে দিতে পারেন। হলান্ডের মধ্যে সেই যোগ্যতা এখনো পরিপূর্ণভাবে আসেনি। তিনি কেবল গোলপোস্টের সামনে থেকে গোল করতে পারেন। তা ছাড়া ম্যানচেস্টার সিটির বড় ম্যাচগুলোতে তাঁর গোল নেই। বিশেষ করে চ্যাম্পিয়নস লিগ ও এফএ কাপের সেমিফাইনাল, ফাইনাল এবং কারাবো কাপের ফাইনালে গোল পাননি ২২ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড।