রাস্তার আইসক্রিম বিক্রেতার মাইকের বিকট শব্দে মাথাধরা নিয়ে ঘুম ভাঙল অংকুরের। মাথার ওপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে সে। ঘ্যার ঘ্যার শব্দ করে ঘুরে চলেছে। নিচের লেদের দোকান থেকে ঘটাং ঘটাং শব্দ ভেসে এসে মাথার যন্ত্রণাটাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। চোখ বুজে আরও কিছুক্ষণ পড়ে থাকার চেষ্টা করল সে। এমন সময় বালিশের নিচে থাকা মোবাইলটা ভাইব্রেট করতে থাকলে চোখ বন্ধ করেই ওটাকে তুলে নিয়ে কানে ধরল অংকুর। ওপাশ থেকে ভেসে আসা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারল ছোট বোন রাইসা—
‘ভাইয়া! গতকাল বাবা আমার জন্য ঈদের নতুন জামা কিনে এনেছে। খুব সুন্দর লাল জামা, আবার মেহেদিও কিনে দিয়েছে একটা। মায়ের জন্য একটা শাড়ি আর নিজের জন্য একটা পাঞ্জাবি কিনেছে। মায়ের শাড়িটা খুব সুন্দর হয়েছে। কিন্তু বাবার পাঞ্জাবির রং আমার পছন্দ হয়নি। আজকে পাল্টে নিয়ে আসতে বলেছি বাবাকে। তুমিও একটু বলবা। (একনিশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল রাইসা)
‘আচ্ছা, তুই খুশি হয়েছিস? জামা পছন্দ হয়েছে তোর? একটু হাসি দিয়ে বলল অংকুর।
‘খুব। ভাইয়া তুমি আসবে কবে?’
‘আমার এবার যাওয়া হবে না রে সোনা। সামনে পরীক্ষা।’
‘ওহ!’ মন খারাপ করে ফোনটা বাবার কাছে দিয়ে দিল রাইসা।
বাবার সঙ্গে সাংসারিক কিছু কথা বলে ফোনটা রেখে দিল অংকুর। মায়ের সঙ্গে আর কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। না যাওয়ার কথা শুনে কান্নাকাটি করবে। ফোনটা রেখে ছোট বোনটার জন্য মনটা খারাপ লাগছে।
বিছানা থেকে উঠে বসল অংকুর। হাত বাড়িয়ে বিছানার পাশের পড়ার টেবিলটা থেকে ব্ল্যাক ডায়মন্ড সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটারটা নিয়ে রুমের বাইরে আসার জন্য উঠল। মাথাটা এখনো ঝিম ধরে আছে। দরজার হুকটা খুলে পাল্লা দুটি একটু সরাতেই কড়া রোদ চোখে এসে লাগল। বাইরে ছাদের কার্নিশে এসে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল সে। দুইতলা বাড়ির চিলেকোঠার ঘর আর ছাদটা তাদের দুই বন্ধু অনেকটা সৌভাগ্যক্রমে পেয়েছে। রাহুল বাড়িতে যাওয়ায় এখন অবশ্য পুরোটাজুড়ে তার একারই আধিপত্য। নিচের ব্যস্ত রাস্তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে পলেস্তারা ওঠা নিজের বর্তমান আবাসের দিকে তাকাল সে। এক কুণ্ডলী ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ভাবল, এখানে আর কত দিন পার করতে হবে তার। নিজের অজান্তেই ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল।
দুই বছর হলো একটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স শেষ করে ঢাকায় চলে আসে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে। একটা ভালো সরকারি চাকরি পেতে হবে। বাবা মো. আব্দুস সালাম সরকারি পোস্টমাস্টার। মা রাহেলা খাতুন পুরোদস্তুর গৃহিণী, আর বোনটা এবার ক্লাস সিক্সে পড়ে। ছোট এক ভাইও ছিল, বছর তিনেক আগে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেছে।
ঢাকায় চাকরির কোচিং করতে এসেই রাহুলের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। দুজনের ভালোই ভাব জমে। বছরখানেক হলো পরামর্শ করে এখানে এসে উঠেছে। মেসে বেশি লোকের মধ্যে পড়াশোনায় সমস্যা, তাই খরচ টানতে একটু কষ্ট হলেও এটাই ওদের কাছে ভালো ব্যবস্থা বলে মনে হয়েছে। সারা রাত পড়া, দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঘুম। তারপর নিচের এক হোটেলের সঙ্গে মাসিক বন্দোবস্ত করা আছে, সেখান থেকে সকালের নাশতা আর দুপুরের খাবার একসঙ্গেই হয়ে যায়। সেখান থেকে টিউশনের জন্য যে যার পথ ধরে। রাত ৮-৯টা পর্যন্ত টিউশন করে নিচের হোটেল থেকে রাতের খাবার খেয়ে ঘরে ফেরা। এই হলো নিত্যকার রুটিন।
শুধু ব্যতয় ঘটে মাঝেমধ্যে শুক্রবারে। শুধু শুক্রবার বলে নয়; চাকরিপ্রত্যাশীদের ভাগ্যের ক, খ, গ, ঘ পূরণ হয় এই দিন। কত হলো, কত তে যাবে— এসব হিসাব–নিকাশ চলতে থাকে আর জমতে থাকে হতাশার পারদ।
অনেক দিন বন্ধ থাকার পর সামনে আবার চাকরির পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে। এবার আর পড়াশোনায় কমতি দেওয়ার সুযোগ নেই। এই কোরবানির ঈদ বাদ গেলেও সামনের বছর পরিবারের সবাইকে নিয়ে অনেক মজা করে ঈদ করার ইচ্ছা অংকুরের। একটা বড় ছাগল কিনবে কোরবানির জন্য। সকালে নামাজ পড়ে এসে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে ছাগল কোরবানির পর মাংস কাটতে বসবে। ছোট বোনটার জন্য বড় মার্কেট থেকে একটা নীল জামা কিনবে। মায়ের জন্য একটা জামদানি শাড়ি কেনার খুব ইচ্ছা। স্বপ্ন বুনতে থাকে সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে।
আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে রুমের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগল অংকুর। দরজার সামনে আসতেই দেখতে পেল ফ্যানের বাতাসে টেবিলের ওপর রাখা নোটের পাতাগুলো উড়ে চলেছে...।
বন্ধু, ঝিনাইদহ বন্ধুসভা