মেয়েদের মতো ছেলেরাও তো কত কিছুতে আটকায়। তবে সাদ আটকে যায় মায়ায়। সাদের আবার মায়া জন্মাতে অন্যদের মতো খুব বেশি সময় লাগে না। ভালো করে কেউ কিছুদিন কথা বললেই তার মায়ায় জড়িয়ে যায়। অপর পাশের ব্যক্তিকে কে বোঝাবে এ কথা? তাই তো বারবার মায়ার বন্ধন ভাঙার কারণে সাদের এখন খুব ভয় করে, কখন আবার মায়ায় জড়িয়ে যায়। বন্ধন ভাঙার তীব্র কষ্ট তাকে ভোগায় বাকি দিনগুলোতে। সাদ যেমন মায়ায় আটকে যায়, এমন কেউ কি নেই যে সাদের মায়ায় আটকে তাকে ধরে রাখবে জীবনের শেষনিশ্বাস অব্দি!
পুরো নাম আতিফ জামান সাদ। ছোটবেলায় মামার হাত ধরে পাড়ার এক কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে পড়ালেখার যাত্রা শুরু। বছরখানেক পর মামার হাত ধরে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয় যেন এটা তো সেদিনেরই কথা। তারপর একে একে ৬ বছর পড়ালেখা শেষ করে সরকারি স্কুলে শুরু হয় মাধ্যমিকের পড়ালেখা। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত সাদের পরিবার থাকত ভাড়া বাসায়। এক বছর পর স্থানান্তরিত হয় তার বাবার তৈরি নিজ বাড়িতে।
মাধ্যমিকে পড়ার সময় স্কুলে যাওয়া-আসার জন্য প্রতিদিন ৩০ টাকা করে পেত সাদ। বাসা থেকে টেরিবাজার আসতে রিকশায় খরচ পড়ত ১৫ টাকা, একটু দরদাম করলে ১২ টাকায়ও পাওয়া যেত। টেরিবাজারে রিকশা থেকে নেমে স্কুলের দূরত্ব হাঁটা রাস্তায় মিনিট পাঁচ-দশেকের মতো। স্কুলে ঠিক সময়ে পৌঁছানোর তাড়া থাকত, না হয় স্যারদের বেতের বাড়ি খাওয়ার ভয় থাকে। তাই সকালবেলা রিকশা পেলেই চড়ে বসত ১৫ টাকা দরে। ফেরার সময় চেষ্টা করত যেন ১২ টাকায় ফিরতে পারে। তাহলে ৩টা টাকা জমানো যাবে। টাকা বাঁচানোর এ চেষ্টাকে যদি ভেবে থাকেন সাদ হয়তো জমানোর জন্যই বাঁচাচ্ছে কিংবা বড় কোনো খেলনা বা সাইকেল কেনার জন্য, তাহলে একেবারেই ভুল ভেবেছেন। রিকশা ভাড়া বাঁচিয়ে লালদীঘির পাড়ে মালঞ্চে খেতে পারাই ছিল তার টাকা জমানোর মূল উদ্দেশ্য। তখন ১০-১২ টাকায় চপ বার্গার পাওয়া যেত। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় দামি কিছু খেতে ইচ্ছা জাগলেও শখ-আহ্লাদ মেটাতে হতো এই চপ বার্গার কিংবা শিঙাড়া-জিলাপির মাধ্যমে।
স্কুল শেষ করে কলেজ, তারপর বিশ্ববিদ্যালয় আর এখন চলছে চাকরিজীবন। এই পথটুকু পাড়ি দিতে সাদ যে কতবার কতজনের সঙ্গে মায়ায় জড়িয়েছে, তা ভাবলে এখনো মনের গহিন কোণে সেই মায়ার সম্পর্কের শূন্যতাটুকু কাঁদিয়ে দেয়। মিশনারি স্কুলে পড়াকালীন বন্ধুত্ব আর স্কুলের সঙ্গে প্রথমবারের মতো গভীর মায়ায় জন্মে যায় সে। সেই ৫-৬ বছরে যে বন্ধুগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বের মায়ায় আটকেছিল সাদ, তাদের বেশির ভাগই এখন তাকে আর মনে রাখেনি। হয়তো কারও স্মৃতিতে আছে, কিংবা এটা ভ্রান্ত ধারণা যে কেউ তাকে মনে রাখবে। কিন্তু সাদের ঠিকই মনে পড়ে, দল বেঁধে টিফিন ছুটিতে মাঠে দাপিয়ে বেড়ানোর কথা। স্কুলপ্রাঙ্গণে ছিল সারি সারি বাদামগাছ। গাছ থেকে পড়া বাদাম আর স্কুলের বই কিংবা খাতা দিয়ে ক্রিকেট খেলার সেই স্মৃতিগুলো এখনো ফেরার তাড়না দেয় ছোটবেলার সময়ে। স্কুল ছেড়ে যাওয়ার সে কষ্ট কাকে বোঝাবে সাদ, হয়তো তখন ছোট থাকাতে অতটা অনুভূত হয়নি।
একাকিত্বের এই শহরে সাদ যেন সম্পূর্ণ একা। সে এত দিন যেসব মায়ায় জড়িয়েছে, তা হয় কোনো বন্ধুত্বের অথবা স্মৃতির মায়ায়। কখনো সে কোনো মেয়ের মায়ায় পড়েনি। পড়বেই-বা কোথা থেকে, আশপাশে তেমন কেউ ছিলই না, যার সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে। মিশনারি স্কুলে পড়াকালে মেয়েদের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলাটা নিতান্তই দুঃসাহসিক কাজ মনে হতো।
মাধ্যমিকের গণ্ডিতে এসে নতুন বন্ধুদের মায়ায় আবার আটকে গেল সাদ। স্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাস চলাকালে দুষ্টুমির কথা, টিফিন পিরিয়ড কিংবা স্কুল ছুটির পরে বেঞ্চের কাঠ বা নারকেলগাছের ডাল ভেঙে তা দিয়ে ক্রিকেট খেলার কথা, টেনিস বল দিয়ে ফুটবল খেলার সেই সময়টুকু যেন স্বর্গ ছিল। এখন ভাবতেই সাদের মন চায়, জীবনের সেরা দিনগুলোতে ফিরে যায়। স্কুল শেষে বন্ধুরা সবাই যখন কলেজে উঠল, তখন সেই মায়ায় দূরত্ব অনেকটাই বেড়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে যখন স্কুলের বন্ধুগুলো একে একে আপন শহর থেকে দূরে চলে গেল, বড়ই একা হয়ে পড়ল সে।
কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে গুটিকয় বন্ধু পেলেও তাদের সঙ্গে দেখা হতো শুধু কলেজ এবং ভার্সিটিতে গেলেই। আগের মতো আলাদা করে ওইভাবে মায়ায় পড়তে পারেনি সাদ। তার মায়ার বন্ধন ভাঙার যে হাহাকার, তা কেউ কখনো জানতে পারে না, কেউ ছেলেটার খোঁজ নেয় না। কোলাহলপূর্ণ এই শহরে মানুষের সময় কোথায় সাদদের একটু খোঁজ নেওয়ার। নতুন করে যদি কেউ মায়ায় আটকে রাখত, তাহলে হয়তো কোনো সাদই কখনো নিজেকে নিঃশেষ করার এত জটিল এবং জীবনের কঠিনতম সিদ্ধান্তটুকু নিত না। সবাই কি আর সাদের মতো দৃঢ় মনোবল ধারণ করে যে এত ব্যথা সহ্য করে সামনে আবারও মায়ার খোঁজে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
একাকিত্বের এই শহরে সাদ যেন সম্পূর্ণ একা। সে এত দিন যেসব মায়ায় জড়িয়েছে, তা হয় কোনো বন্ধুত্বের অথবা স্মৃতির মায়ায়। কখনো সে কোনো মেয়ের মায়ায় পড়েনি। পড়বেই-বা কোথা থেকে, আশপাশে তেমন কেউ ছিলই না, যার সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে। মিশনারি স্কুলে পড়াকালে মেয়েদের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলাটা নিতান্তই দুঃসাহসিক কাজ মনে হতো। সরকারি স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বলার সুযোগই ছিল না। সব কটিই ছিল ছেলেদের প্রতিষ্ঠান।
সাদের এক বন্ধু রাহিতের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে পরিচয় হয় তার বন্ধুদের একটা সার্কেলের সঙ্গে। ধীরে ধীরে আড্ডা দেওয়া শুরু করে। পুরোনো মায়ার ক্ষত ভুলে এখন সে রাহিতদের মাঝে নতুন মায়ার খোঁজ করে বেড়ায়। সেই গ্রুপে ছেলেরা ছাড়াও বেশ কয়েকজন মেয়েও ছিল। কিন্তু সাদ কখনো কথা বলত না। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সেই সাহসই হতো না তার। তবে সবার চোখের আড়াল হয়ে প্রতিনিয়ত একটা মেয়েকে লুকিয়ে দেখত। ধীরে ধীরে তার ওপর দুর্বলতা কাজ করতে শুরু করে। প্রায় বছর দুয়েক পর হঠাৎ একদিন মেয়েটিই আগ বাড়িয়ে কথা বলতে এল সাদের সঙ্গে। সামিরা হাসান নামের মেয়েটি দুয়েক বছরের ছোট হবে। সেই থেকে কথার শুরু। প্রতিনিয়ত কথা হতো না। দেখা হলেই কথা হতো, যার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত সাদ। আড্ডায় সামিরা নিয়মিত আসত না, ঠিক কোন দিন আসবে, তা জানার উপায়ও ছিল না। কেউ যদি জেনে যায়, তাহলে আবার বিপত্তি বাধতে পারে; এ জন্য সাদ কারও কাছে জিজ্ঞেসও করতে পারে না। সামিরাকে এক পলক দেখার জন্য একেকটি দিনের অপেক্ষা যেন এক যুগ। দেখা হলেই কথা হতো দুজনের; কিন্তু কখনো ভালো লাগার কথা আর বলা হয়ে ওঠে না।
একবারই মাত্র সুযোগ হয়েছিল দুজন পাশাপাশি হাঁটার। বৃষ্টিভেজা সেই রাতে সাদ চেয়েছিল সামিরার হাতে হাত রেখে ভালো লাগার কথাগুলো বলতে। কিন্তু সে যদি রাজি না হয়, কথা বলা বন্ধ করে দেয়! এই ভয়ে কখনো বলা হয়ে ওঠেনি মনের কথাগুলো। সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলছিল।
একদিন হঠাৎ সামিরা শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। পড়ালেখা শেষ হয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রাম ছেড়ে একেবারের জন্য চলে গেল গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জে। যেদিন শেষবারের মতো রাহাতের সার্কেলের সবার সঙ্গে দেখা করতে এল সামিরা, সেদিন সাদের বুকটা কেঁপে উঠল। হৃদয়ে এতটাই শূন্যতা অনুভব করছিল যে মনের অজান্তেই চোখের কোণে জল এসে পড়ে। সবার চোখের আড়াল হয়ে নিজেকে সামলে নিল। সেই রাত ছিল সাদের জীবনের দীর্ঘতম রাতগুলোর মধ্যে একটি। এই মায়ার বন্ধন আগেরগুলোর থেকে অনেকটাই তীব্র ছিল। সামিরার সঙ্গে প্রথম কথোপকথনের সেই স্মৃতি আজও জীবিত রয়েছে জামালখান কুয়ার পাড়ে; যার সাক্ষী পরিত্যক্ত কুয়াটি, কুয়ার পাড়ের সেই লিচুগাছ ও আশপাশের স্থাপনাগুলো।
বেশ অনেকদিন লেগেছিল স্বাভাবিক হতে। এবার সাদ খুব সাবধান; একেবারে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কারও মায়ায় জড়ানো যাবে না। রাহিতদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে ধীরে ধীরে তার বন্ধু সংখ্যাও বাড়তে লাগল। সামিরার মায়া ভুলে থাকার জন্য সে আবারও মায়ার খোঁজে। সেই সময়ে পরিচয় হয় নাদিয়ার সঙ্গে। বয়সে জুনিয়র। আসল হচ্ছে মনের মিল। মনে হচ্ছিল, এত দিন হয়তো তারই খোঁজে ছিল সাদ। নাদিয়া দুরন্ত প্রকৃতির এবং আচরণ কিছুটা শিশুসুলভ। বেশ কিছুদিন কথা বলেও নাদিয়া আর তার মধ্যে কোনো মিল খুঁজে পেল না সাদ। এ কারণে সে আর মায়ায় জড়ায়নি। এখনো কথা হয় নাদিয়ার সঙ্গে। এখন সামলে নিয়েছে নিজেকে।
জীবন বড়ই একা। সাদের অগোছালো জীবন গুছিয়ে দেওয়ার জন্য এমন কাউকে খুব দরকার ছিল, যার মায়ায় সে ডুবে থাকবে বাকি জীবন। যে তার সম্পূর্ণটাই বুঝবে, খেয়াল রাখবে। এরই মধ্যে একদিন আচমকা পরিচয় নবনীতার সঙ্গে। মেয়েটির কাজল কালো চোখের চাহনি তার মায়ায় পড়তে বাধ্য করেছে। সে কখনো গায়ের রং দেখে মায়ায় পড়েনি। শ্যামল বর্ণের মেয়েটির মুখে একটা তিল আছে, ঠিক তার নিজের মতোই। এটাও নবনীতার প্রতি আগ্রহের অন্যতম কারণ। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কথার শুরু, এরপর প্রতিনিয়ত চলছে কথার ফুলঝুরি। এই অল্প সময়ের মধ্যে কয়েকবার দেখাও করেছে। তবে সাদ শঙ্কায় রয়েছে। কিছুদিনের পরিচয়ের পর আবারও যদি হারিয়ে যায়! সেই শক্তিটুকু নেই সাদের যে কাউকে হারিয়ে পুনরায় আবারও মায়ার খোঁজে এগিয়ে যাবে। এর একটি সমাধান চায় সাদ। এমন কাউকে চায় যে সারা জীবন মায়ায় আটকে রাখবে। নবনীতাই কি তবে সাদের খুঁজতে থাকা সেই চিরস্থায়ী মায়া? নাকি আবারও বেরিয়ে পড়তে হবে নতুন কোনো মায়ার সন্ধানে।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা