পাহাড়ি জীবন আমাকে যে শিক্ষা দিল

বান্দরবানের একটি পাহাড়ি গ্রামছবি: লেখকের সৌজন্যে

বান্দরবানের বিশাল একটা অভিজ্ঞতা যোগ হয়েছে আমার জীবনে। তিন রাত-চার দিনের এই ভ্রমণে আমার জীবনে নানা ধরনের প্রতিকূল ও চমৎকার কিছু মুহূর্ত হাজির করেছে। এই অল্প কয়েক দিনের পাহাড়ি জীবনের জীবন-ভাবনায় বিশাল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। আগের বিচ্ছিন্ন চিন্তাভাবনা পরিপূর্ণ আঙ্গিকে ধরা দিচ্ছে চিন্তনে। ভেবে অস্থির হয়ে যাই, বাংলাদেশের নাগরিক জীবনের চাইতে অধিক অনগ্রসর একটি জাতিগোষ্ঠী কীভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন অধিকার করে আছে জঞ্জালপূর্ণ নাগরিক জীবনের সীমানার ভেতরে। সেখানকার পরিবেশ আমাদের অন্যান্য জেলার গ্রামগুলোর চাইতে অনেক বেশি সুগঠিত-সুপরিশীলিত।

বান্দরবানের পাহাড়ি গ্রামগুলো দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছি, বাড়ির গঠন ও পাড়া কাঠামো আমাকে খুবই ভাবিয়ে তুলছে যে এখানকার প্রতিটা বাড়িতে একটা করে মাচা; যেখানে পরিবারের সব সদস্য বসে একসঙ্গে সময় উপভোগ করে। ঘরের কাজগুলোও হয় এই মাচাতে বসেই। পিতা কাজ করবেন, বাচ্চারা পড়াশোনা করবে, খেলবে নাচবে গাইবে, মা জুমে কাজ করতে যাবেন এবং কাজের শেষে তারা যখন একত্র হয়, মাচাতে বসে খাওয়া-ঘুমানোসহ অন্য সাধারণ কাজগুলো হয়; এর মাধ্যমে পরিবারের প্রত্যেক সদস্য মহূর্তগুলোকে আরও গাঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারে। তাদের পরিবেশ ও অবস্থানই তাদের এমন পদক্ষেপগুলো নিতে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে পালন করে।

সুন্দর সুন্দর বাড়ি, খাওয়াদাওয়া পরিষ্কার, বাড়ির আঙিনা গোছানো এবং বাড়ির পাড়াগুলোর ব্যবস্থাপনায় বড়দের প্রাধান্য ও পাড়ার কর্মকাণ্ডে তরুণদের অংশগ্রহণ, আয়োজন; ছোটদের প্রতি তাদের স্নেহ ও ভালোবাসা আমাকে ভাবাতে শুরু করেছে, আমরা এত দিন কিসের মাঝে বড় হয়েছি? আমাদের বড় হওয়ার মধ্যে কোথাও যেন একটা ফাঁক থেকে গেছে। পাহাড়ের মানুষের মন সবচাইতে বেশি সুন্দর এবং পরিষ্কার। তারা আমাদের যেভাবে সমাদার করেছে এবং সহযোগিতা করেছে, তা আমি বাংলাদেশের অন্য কোনো প্রান্তে দেখিনি।

পাহাড় থেকে শহরে ফেরার সময় যতই নাগরিক যান্ত্রিক জীবনের দিকে এগোচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল শরীর টানছে না। নিদারুণ বেদনায় কাতর হচ্ছিলাম। চিৎকার করে প্রকাশ করলে তা গাড়ির কালো কাচ ভেঙে খান খান হয়ে যেত। অন্তরের অসহ্য জ্বালা সত্ত্বেও ফিরতে হচ্ছে নাগরিক জঞ্জালে।

এই ফেরা দীর্ঘ না হোক, স্বল্প হোক। আমার মন পড়ে আছে পাহাড়ে, ঝিরিতে, পাড়ায়-পাড়ায়, পাহাড়ের কোলঘেঁষে যে পথ চলে গেছে আরেক দেশে, আমাকে টানছে সে পথ। আমাকে তোমরা আটকাইতে পারবা? কিসে তোমরা আটকাবা? আমার অস্তিত্ব আমারে আবার পাহাড়ের কাছে নিয়া যাবে। আমি হারায়া যাব, খুঁজে নিব আমার আমিকে ঐ দূর পাহাড়ে।

শিক্ষার্থী, নাট্যকলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়