অরণ্য নিবাসে পাতা ঝরা এক প্রভাত

শ্রীমঙ্গলের অরণ্য নিবাসে বন্ধুদের সঙ্গে লেখকছবি: লেখকের সৌজন্যে

কবি জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত একটা কবিতার দুটি লাইন খুব মনে পড়ছে, ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও—আমি এই বাংলার পারে/ র’য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে।’

আচ্ছা আপনারা কি কেউ ভোরের বাতাসে কাঁঠালপাতা ঝরতে দেখেছেন? আর দেখলেও কি এর অকৃত্রিম সৌন্দর্যটা উপভোগ করেছেন? অনেকেই দেখেননি, কেউ কেউ হয়তো দেখেছেন। আমি দেখেছি, দেখেছি ভোরের মৃদু বাতাসে কাঁঠালগাছের পাতাগুলো আস্তে করে মাটিতে ঝরে পড়ছে, সঙ্গে চারদিকে পাখির কলকাকলিমুখর সংগীতময় ধ্বনি। অরণ্য নিবাসে এক সকালে প্রাকৃতিক সব সৌন্দর্য যেন একত্র হয়ে ধরা দিয়েছিল চোখে!

‘অরণ্য নিবাস’ হলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি শ্রীমঙ্গলের ভানুগাছ রেলস্টেশনের কাছে রাধানগর এলাকার একটি ইকো রিসোর্ট। ঈদুল আজহার ছুটিতে ছয় বন্ধু মিলে সেখানে ঘুরতে যাই। দিনটি ছিল ঈদের দিন। খুব সকালে সমরজিতের ফোনে ঘুম ভাঙল। ঘুম থেকে উঠেই বাইরে তাকিয়ে দেখি প্রবল বৃষ্টি। সৌমেন কল দিলে বলল, ওর এলাকায় হাঁটুসমান পানি হয়ে গেছে।

যাহোক, বৈরী আবহাওয়া এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশে রওনা হই। বেলা ১১টায় বাসে উঠি এবং বেলা ১টায় গন্তব্যে পৌঁছে যাই। সেখানে আরেক বন্ধু আকাশ আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। পরে একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে অটোরিকশায় রিসোর্টের উদ্দেশে রওনা দিই। রাস্তা খুবই সুন্দর। দুই দিকে যত দূর চোখ যায়, শুধু চা–বাগান আর আঁকাবাঁকা রাস্তার দুই পাশে বড় বড় গাছ; যেকোনো পর্যটককে মুগ্ধ করবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছে গেলাম।

অরণ্য নিবাসে ছোট-বড় অনেকগুলো কুটির আছে। যে কুটিরে অবস্থান করেছিলাম, তার নাম ‘মহুয়া’। অত্যন্ত সুন্দর এই কুঠির। একটা ব্যালকনি আছে, যেখানে শোভা পেয়েছে সুন্দর দোলনা ও একটি বাঁশের তৈরি চেয়ার। অনেকটা উঁচুতে কুটিরটির অবস্থান হওয়ায় ব্যালকনি থেকে বড় বড় টিলা, পাহাড়, গাছগাছালি ও নিচে আনারসবাগান দেখা যায়। এখানে বসে বৃষ্টিবিলাস যেকোনো প্রকৃতিপ্রেমী কিংবা অরণ্যপ্রেমীকে মুগ্ধ করবে।

আমরা ব্যালকনিতে গিয়ে নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলে এবং কিছুটা সময় গল্পগুজব করে চলে যাই সুইমিংপুলে। রিসোর্টের সুইমিংপুলটা যথেষ্ট বড়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, গান শুনতে শুনতে সাঁতার কাটার জন্য তারা একটা সাউন্ড বক্সও রেখেছে। আমরাও গান চালিয়ে মহানন্দে সাঁতার কাটতে শুরু করি। সবাই গোসল সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই।

অরণ্য নিবাসের সুইমিংপুলে লেখক

বিকেলবেলা রিসোর্টটির চারপাশ ঘুরে দেখার জন্য বের হই। দেখলাম, তারা নানা রকম পাখি ও খরগোশ পালন করে। একটু সামনে এগিয়ে নিচে নেমে দেখি সেখানে বিশাল একটি লেক রয়েছে, যেখানে বোট চালানোরও সুযোগ আছে। পাশেই বেশ খানিকটা জায়গাজুড়ে একটি মুক্তমঞ্চ; যেখানে ছোটখাটো কনসার্ট করাও সম্ভব। পাশেই আছে বারবিকিউ করার সরঞ্জামাদি। অনেকক্ষণ ঘোরাফেরা করে সন্ধ্যায় নাশতার জন্য একটা সুসজ্জিত লাউঞ্জে যাই। নাশতা শেষ করা মাত্রই সৌমেন তাঁর উকুলেলে দিয়ে গান শুরু করল; সঙ্গে তাল মেলালাম আমরাও। এক এক করে আবদুল করিম, হাছন রাজা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, রাধারমণ, গিয়াসউদ্দিন, শীতালং ফকির, লালন শাহ, শাহ সুন্দর আলী, দূরবীন শাহ, হুমায়ূন আহমেদ, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, কবির বকুলসহ বাংলাদেশের বিখ্যাত গীতিকার ও শিল্পীদের গান গাইলাম। আমাদের গান শুনে আশপাশের অনেকেই ছুটে আসেন।

গানবাজনা শেষ করে রাতের খাবার খেতে এবং বন্ধু সাদমানকে রিসিভ করতে চলে গেলাম ভানুগাছ। ঈদের দিন হওয়ায় সে ঈদের নামাজ পড়ে খাওয়াদাওয়া করে রাতে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। সাদমানকে কাছে পেয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলাম। রাত ১০টার সময় রিসোর্টে ফিরে আসি। ব্যালকনিতে বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে সবাই আবার সুইমিংপুলে চলে গেলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সাঁতার কাটতে পারিনি। কর্তৃপক্ষ নতুন করে পানি ওঠানোর জন্য আগের পানি ছেড়ে দিয়েছিল।

রাত তখন একটা। আশপাশে কোনো বাসাবাড়ি না থাকায় বাইরে এসে আবারও গলা ছেড়ে গান গাওয়া শুরু করলাম। রাত ৩টার সময় কুটিরে ফিরে আসি। কিছুক্ষণ পর সমরজিৎ ও সাদমান ঘুমিয়ে পড়ল। বাকিরা জেগে রইলাম।

বিশাল এই রিসোর্টে নিস্তব্ধ ভোরে কেবল আমিই জেগে রইলাম আর কিছু পাখি। ভোরের বাতাসে গাছের পাতাগুলো টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে।

সূর্যের আভা তখন কিছুটা প্রতীয়মান। সূর্য ধীরে ধীরে উদিত হচ্ছে। সূর্যের লালা আভা চারপাশের পরিবেশকে আরও সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তোলে। মৃদু বাতাস আর পাখিদের কলকাকলির শব্দ শুনে আমি, অন্তর আর সৌমেন ব্যালকনি থেকে বাইরে চলে আসি। তিনজন তিনটা দোলনায় দুলতে দুলতে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করার পর তারাও ঘুমাতে চলে গেল।

বিশাল এই রিসোর্টে নিস্তব্ধ ভোরে কেবল আমিই জেগে রইলাম আর কিছু পাখি। ভোরের বাতাসে গাছের পাতাগুলো টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে। কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে লেকের পাশে গিয়ে বসলাম। প্রকৃতি যে কতটা সুন্দর, সেটা ভারতে গিয়ে একদিন বুঝেছিলাম আর সেদিন আবারও উপলব্ধি করলাম। কিছুক্ষণ পর শুরু হলো প্রচণ্ড বাতাস ও বৃষ্টি। দৌড়ে কুটিরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘণ্টাখানেক পর অন্তরের ডাকে ঘুম ভাঙল। সবাই মিলে ব্যালকনিতে বসে বৃষ্টি উপভোগ করলাম। ব্যালকনির একদম কাছেই আনারসবাগান। আনারসগাছে আছড়ে পড়া বৃষ্টির শব্দ, মাথার ওপরে টিনের শব্দ—এ যেন দারুণ এক ঐকতান!
কিছুক্ষণ পর সকালের নাশতা করতে ক্যাফেতে গেলাম। ফিরে এসে ব্যালকনিতে বসে আবার গান শুরু করলাম, বাইরে তখনো ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দ আর আমাদের গলার সুর যেন মিলেমিশে একাকার। হঠাৎ সৌমেন আনারস খাওয়ার জন্য বায়না ধরল। সরাসরি বাগান থেকে আনারস তোলে আমিও কখনো খাইনি। তাই আমারও ইচ্ছা জাগল। সঞ্জয়কে (রিসোর্টের পরিচালক) বললাম আনারস এনে দিতে। আনারসবাগানটি রিসোর্টের মালিকানাধীন। মৌসুমে অল্প মূল্যেই ক্রয় করে খাওয়া যায়।
যাহোক, সঞ্জয় আমাদের জন্য সুন্দর করে আনারস কেটে এনে খেতে দিল। আনারসগুলো খুবই রসালো ও সুস্বাদু।

পাতা ঝড়ার দৃশ্য

এবার ফেরার পালা। দুপুর ১২টার সময় ঝুম বৃষ্টির মধ্যেই রিসোর্ট থেকে চেক আউট করে ভানুগাছ রেলস্টেশনে চলে যাই, সিলেট ফেরার উদ্দেশে। গিয়ে শুনি ট্রেন আসতে তিন ঘণ্টা দেরি। অপেক্ষার এই অলস সময় কাটানোর জন্য গান গাইতে শুরু করি। আমাদের গান শুনে স্টেশনের অনেক লোক পাশে এসে জড়ো হয়।

ঘড়িতে তখন বিকেল ৪টা ৫২ মিনিট। বহুল প্রতীক্ষিত পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে থামে। আমরাও মহা আনন্দে ট্রেনে উঠে পড়ি। কিন্তু কোনো সিট ফাঁকা ছিল না। দাঁড়িয়ে থেকেই ফিরতে হলো।
সিলেট পৌঁছে একটি রেস্তোরাঁয় সবাই একসঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে যার যার বাসায় ফিরে যাই।

আজ যখন কথাগুলো লিখছি, অরণ্য নিবাসে কাটানো স্মৃতিময় মধুর দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি, অনেক স্মৃতি জমা আছে; কিন্তু এই রিসোর্টে দেখা ভোরের বাতাসে গাছ থেকে পাতা ঝড়ার দৃশ্য, সূর্যোদয় উপভোগ করা, রাত জেগে গানবাজনা করা, আড্ডা দেওয়ার স্মৃতিগুলো কখনো ভুলব না। সারা জীবন মনে থাকবে।

সাধারণ সম্পাদক, সিলেট বন্ধুসভা