ইমা কেইথেল বা মায়েদের মার্কেট

ইমা কেইথেলছবি: ওয়াল্ড আটলাস

আপনি যদি প্রথমবার ‘ইমা কেইথেলে’ যান, তাহলে প্রথম দেখায় এটিকে আট-দশটি সাধারণ মার্কেট মনে হবে। তবে কিছুক্ষণ পরই ভুল ভাঙতে বাধ্য! তিনটি ভবনের এই মার্কেটে পাঁচ হাজারের অধিক দোকান রয়েছে। গৃহস্থালি জিনিসপত্র থেকে শুরু করে তাজা মাছ, শাকসবজি, মাংস, ফলমূল, কাঁচাবাজার, পোশাকসহ সবকিছু পাওয়া যায়। তবে অন্য মার্কেট থেকে এটি আলাদা একটি কারণে। আর তা হলো, সব দোকানের বিক্রেতা এবং পরিচালক নারী। এমনকি নিয়ম রয়েছে, এই মার্কেটে ব্যবসা করতে হলে অবশ্যই বিবাহিত নারী হতে হবে।

মার্কেটটি ভারতের মনিপুর রাজ্যের রাজধানী ইমফালে অবস্থিত। স্থানীয় ভাষার শব্দ ‘ইমা’ অর্থ মা এবং ‘কেইথেল’ অর্থ মার্কেট। অর্থাৎ মায়েদের মার্কেট। এটি নুপি কেইথেল বা নারীদের মার্কেট নামেও পরিচিত। এখানে নুপি অর্থ নারী। এটিকে নারীদের পরিচালিত বিশ্বের বৃহত্তম মার্কেটও বলা হয়।

৫০০ বছরের পুরোনো এই মার্কেটে পুরুষদের ব্যবসা করা নিষেধ। তবে তাঁরা ঢুকতে এবং কেনাকাটা করতে পারেন। এর শুরু ১৬০০ শতকে কাংলিপাক রাজ্য থাকার সময় থেকে। সে সময় পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার ও চীনের আক্রমণ থেকে রাজ্যকে বাঁচাতে স্থানীয় সব পুরুষকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হতো। বিশেষ করে যাঁদের বয়স ১৭ থেকে ৬০ বছর। ফলে গৃহস্থালীয় থেকে শুরু করে ঘরের সব কাজের দায়িত্ব নারীদের কাঁধে এসে পড়ে। জীবিকা নির্বাহের জন্য তাঁরা কাপড় বোনা ও কৃষিকাজেও হাত লাগান। এভাবেই ধীরে ধীরে ইমা কেইথেল গড়ে ওঠে। তবে শুরুর দিকে আলাদা কোনো মার্কেট ছিল না। তখন খোলা আকাশের নিচে বাজার বসত।

ইমা কেইথেল
ছবি: সংগৃহীত

এখানকার নারীরা যে শুধু ব্যবসা করেন, তা নয়। ৫০০ বছর ধরে স্থানীয় সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতেও তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। ১৮৯১ সালে মার্কেটের নারীদের বিক্ষোভের ফলে তৎকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকেরা তাঁদের প্রবর্তিত বিভিন্ন সংস্কার বাতিল করতে বাধ্য হয়। ১৯৩৯ সালে মনিপুর থেকে ভারতের অন্যান্য অংশে চাল রপ্তানি করার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার। সেই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে স্থানীয় নারীরা সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে আনিশুবা নুপিলান বা দ্বিতীয় নারী যুদ্ধে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। সাম্প্রতিক সময়েও এমন বিক্ষোভের ঘটনা রয়েছে। ২০০৩ সালে তৎকালীন রাজ্য সরকার এই মার্কেটের জায়গায় বহুতল শপিং মল নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিল। এরপরই নারীরা কয়েক সপ্তাহব্যাপী বিক্ষোভ শুরু করেন; এতে রাজ্যের অর্থনীতিতে ধস নামে এবং সরকার তার ঘোষণা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। এমনকি বর্তমান সময়ও এসব নারী বিভিন্ন ইস্যুতে বিক্ষোভে অংশ নিয়ে থাকেন।

আজকাল ইমা কেইথেল মনিপুরের সাম্যবাদী সমাজেরও একটি উদাহরণ। ভারতের সর্বোচ্চ নারী শিক্ষার হার এই রাজ্যে। লিঙ্গ সমতার দিক দিয়েও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তারা। রাজ্যের জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ স্থানীয় মেইতেই নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর। মার্কেটে তাদের প্রভাবই বেশি। তবে রাজ্যের আরও ৩৩টি আদিবাসী গোষ্ঠীর মানুষেরাও সমান সুযোগ পান। সবাই একে অপরকে সহযোগিতা এবং বন্ধুসুলভ আচরণ করেন।