মনের কথা শোনেন

ছোটবেলা থেকে শিশুদের বুঝে পড়ার ওপর জোর দিতে হবে, এতে করে তাদের সৃজনশীলতা বাড়বেছবি: সুমন ইউসুফ

আমার সাত বছরের ছাত্রকে বাক্য তৈরি শেখাচ্ছিলাম। সে একবারেই বুঝে গেল কীভাবে প্রদত্ত শব্দ দিয়ে বাক্য তৈরি করতে হয়। আমিও ছাত্রের বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ। তাকে বললাম, Like, Help, Bird দিয়ে বাক্য তৈরি করো। সে যথাক্রমে লিখল,
I like plane.
I help you.
I like bird.
আমি তো মহাখুশি। আর খুশি আমার ছাত্রও। বাক্য তৈরির মতো এত কঠিন কাজটা সে যে খুব সহজেই করতে পারে! বরং বাক্য তৈরি করার মতো সহজ একটি ব্যাপার আমি কেন তাকে এত সময় নিয়ে বোঝালাম, তা নিয়ে সে আমার ওপর বিরক্ত। পরদিন ছাত্রকে পড়াতে গিয়ে দেখি, তার মা মন খারাপ করে আছে। আমাকে তিনি বললেন, ওকে স্কুলে যেভাবে বাক্য তৈরি শেখায়, সেভাবেই পড়াও।

এ কথার কারণ খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, হোমওয়ার্কের খাতায় আমার ছাত্রের তিনটি বাক্য লাল কালিতে কেটে দেওয়া হয়েছে। মনে পড়ল, বাক্য তৈরির একটি নোট আগেই স্কুল থেকে সব শিক্ষার্থীকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেখানে Like, Help ও Bird-এর বাক্যগুলো আছে যথাক্রমে,
The hen likes to eat worms.
My mother helps me in my study.
The bird is in the nest.

বলা বাহুল্য, হতাশ হলাম। সাত বছরের একটি বাচ্চা নিজে নিজে বাক্য তৈরি করার মতো অসাধারণ একটি ক্ষমতা এক দিনেই হারাল। সে জানল, তার তৈরি করা বাক্যগুলো ভুল। তাকে মুখস্থ করতে হবে প্রতিটি বাক্য। স্পষ্টতই তার ছোট ছোট চকচক করা চোখে আমার প্রতি রাগ দেখতে পেলাম—আমি যে তাকে ভুল শিখিয়েছি! আমাদের অতি পরিচিত দুটি ইংরেজি শব্দ, ‘Education System’ অর্থাৎ শিক্ষাব্যবস্থার ওপর মেজাজ খারাপ করে আমার ছাত্রকে সেদিন বাক্য গুলে গুলে খাইয়েছি। একই দিনে তাকে বাংলা শব্দ দিয়ে বাক্য তৈরি করা গেলাচ্ছিলাম। ‘তৈরি’ দিয়ে বাক্য গঠন হবে—‘সুতা দিয়ে কাপড় তৈরি হয়’। বাড়ির কাজ দিলাম, প্রতিটি বাক্য পাঁচবার করে লিখতে হবে। আমার ছাত্র সেদিন হোমওয়ার্কের খাতায় পাঁচবার লিখেছিল, ‘মুতা (?) দিয়া কাপড় তৈরি হয়।’

ভূমিকা শেষ। এখন আসল কথায় আসি। বুঝে পড়া আর না পড়ে মুখস্থ করার পার্থক্য আমরা সবাই জানি। এভাবেই আমরা বড় হয়েছি একটি ভুল পদ্ধতির সঙ্গে। কিন্তু ছেলেবেলার ভুল যদি বুঝতে শেখার পরও আমরা কাটিয়ে উঠতে না পারি, তবে আমাদের মতো তরুণদের ভবিষ্যৎ কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে যায়। শিক্ষা হলো সফলতার অন্যতম চাবিকাঠি। জীবনে সফল হতে হলে জ্ঞানার্জন করতে হবে। জ্ঞান আসবে শিক্ষা থেকে। আর শিক্ষার্জন করতে হলে শিক্ষাকে ভালোবাসতে হবে। শিক্ষা আর সফলতাকে পাশাপাশি মিলিয়ে জীবনে সফল হওয়া নিয়ে কিছুটা আলোচনা করব। মানুষের জীবনে শিক্ষা গ্রহণের ধাপটি শুরু হয় জন্মের পর থেকেই। আজ আপনি সফলতার মূলমন্ত্র জানলে কাল আপনার পরবর্তী প্রজন্মকে তা জানাতে ও শেখাতে পারবেন। সফলতা বলতে আমরা কী বুঝি? প্রশ্নটা করেছিলাম আমার বেশ কিছু বন্ধুকে। সবার উত্তর ঘুরেফিরে এক, জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানো। পরের প্রশ্ন ছিল, লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে কী করতে হবে? এর উত্তরও সবাই একই রকম দিয়েছে। অধ্যবসায় আর পরিশ্রম। শব্দ দুটি শুনলেই মনে হয় ‘বেশ কঠিন’। কিন্তু কয়েকটি সঠিক ধাপে এগোলে জীবনে সফলতা আনার কাজটি এতটাও কঠিন নয়।

স্বপ্ন দেখুন অনেক বড়
আমরা সবাই কি স্বপ্ন দেখতে জানি? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখা নয়, জেগে স্বপ্ন দেখা। অর্থাৎ আমি ‘কী চাই’, ‘কেমন চাই’—এর উত্তর খোঁজা। যদি আপনি স্বপ্ন দেখতে পারেন আপনার ভবিষ্যৎ নিয়ে, তাহলে অবশ্যই পারবেন সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা করতে। এ ক্ষেত্রে মন ও মস্তিষ্ককে একদম বাধা দেবেন না। তা সে যেমনই হোক না কেন, আর যতই কঠিন মনে হোক। একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে সম্মানজনক ও গুরুত্বপূর্ণ পদ হলো মাননীয় রাষ্ট্রপতির পদ। যথেষ্ট চিন্তাশীল ও বিচক্ষণ না হলে রাষ্ট্রপতি হওয়া যায় না। যদি কোনো মানুষ স্বপ্ন দেখে সে রাষ্ট্রপতি হবে, তবে তাকে নিয়ে অনেকেই হাসাহাসি করতে পারে। কিন্তু সেই মানুষটিই যদি তার স্বপ্ন সফল করার চেষ্টায় নেমে পড়ে, সে রাষ্ট্রের না হোক, অন্ততপক্ষে নিজ এলাকার একজন সফল, দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্ব হতে উঠতে পারে। এটিও কম কি? তাই স্বপ্ন দেখুন বড়, অনেক বড়। আর অবশ্যই নিজের ভালো লাগাকে সবার আগে প্রাধান্য দিন।

তালিকা থেকে বাদ দিন অপছন্দের কাজগুলো
স্বপ্ন দেখা তো হলো। এবার তালিকা করুন আপনার প্রিয় ও অপ্রিয় কাজগুলোর। এমন অনেক কিছুই আমরা করি, যা আসলে আমাদের একেবারেই অপছন্দের। বলা যায়, বাধ্য হয়ে করা। যেমন অনেকেই নিজের পছন্দকে চেপে রেখে পরিবারের কথা ভেবে তাঁদের পছন্দের বিষয়ে পড়াশোনা করেন। আবার কেউ পছন্দ করে ব্যবসা করতে কিন্তু পরিবারের মানুষদের পছন্দ তাঁদের সন্তান চাকরি করুক। এ রকম দোটানায় আমাদের সবাইকে কমবেশি পড়তে হয়েছে বা হয়। কিন্তু মনের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করতে সফলতা তো দূরে থাক, বরং নিজের আরও ক্ষতি করা হয়। ক্ষতিটা যতটা না হয় বাহ্যিক, তার চেয়ে বেশি হয় মানসিক। এভাবে মানুষের স্বাভাবিক সৃজনশীলতা হারিয়ে যায়। এমন অনেক তরুণকে দেখেছি, যারা নিজেদের জীবনের ওপর বিষাদগ্রস্ত। জীবনের কাছে নাকি তাদের কিছু চাওয়ার নেই। ভাবতে অবাক লাগে যে আমার খুব প্রিয় এক বন্ধুর জীবনের সফলতার অর্থ হলো ‘আত্মহত্যা’! এটি কেবল একটি উদাহরণ। এ রকম হাজারো উদাহরণ আমাদের আশপাশেই আছে। এর কারণ এই নয় কি, যে তারা তাদের জীবনকে উপভোগ করছে না? আর জীবনকে উপভোগ তখনই করা যায়, যখন আপনি অন্যের নয়, বরং নিজের ভালো লাগার কাজগুলো করবেন। জীবন এত ঠুনকো নয় যে এর থেকে আমরা মুখ ফিরিয়ে নেব এত সহজেই, যা আপনার করতে ভালো লাগে না, যা আপনি নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে করছেন, তাকে বিদায় বলুন এখনই। নিজেকে বলুন, ‘আজ থেকে তাই করব, যা আমার আত্মার খোরাক।’

আপনি কখনোই কোনো অবস্থাতেই এ রকম চিন্তা করবেন না যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর এই ভেবে জীবনের যেটুকু সময় বাকি আছে, তা আফসোস করে কাটিয়ে দেওয়ার কথা তো ভুলেও ভাববেন না। হতাশার কোনো জায়গা নেই আমাদের সুন্দর পৃথিবীতে। চারপাশে তাকিয়ে দেখুন ভালো লাগানোর মতো অনেক উপাদান পাবেন।

কখনোই হতাশা নয়
মনের বিরুদ্ধে অনেকটা পথ চলে এসে ভাবছেন, এখন ফিরে গিয়ে কী হবে? একটা গল্প বলি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধু আমার চেয়ে আট বছরের বড়। কিন্তু সে আমার ক্লাসেই আমার সঙ্গে পড়ে। ইংরেজি মাধ্যমে বিজ্ঞান বিভাগে খুব ভালো রেজাল্ট করা আমার সে বন্ধুটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘Applied Physics’ অর্থাৎ ‘ফলিত পদার্থবিজ্ঞান’ বিষয়ে পড়াশোনা করত। তৃতীয় বর্ষে ওঠার পর যখন কিনা সে প্রায় স্নাতক শেষের পথে, তখন তার মনে হয়েছে, এ বিষয়ে পড়াশোনা করে সে আনন্দ পাচ্ছে না।

তার ভালো লাগে সৃজনশীল কাজ। সে রকমই কিছু করতে চাইত, আবার লিখতেও ভালোবাসত ছেলেটি। তাই তো সেই বছরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজিটাল প্রোডাকশন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে সে। আমরাও প্রথমে তার ‘বোকামি’তে (?) হাসতাম, আফসোস করতাম। একমাত্র তাকেই দেখতাম দিব্যি হেসেখেলে একটার পর একটা সেমিস্টার দাপিয়ে পার করে দিচ্ছে। আবার ভালো রেজাল্টের জন্য স্কলারশিপও পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। নিজেই গর্ব করে এখন বলে, ‘জীবনের সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলাম মনের কথা শুনে।’

আপনি কখনোই কোনো অবস্থাতেই এ রকম চিন্তা করবেন না যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর এই ভেবে জীবনের যেটুকু সময় বাকি আছে, তা আফসোস করে কাটিয়ে দেওয়ার কথা তো ভুলেও ভাববেন না। হতাশার কোনো জায়গা নেই আমাদের সুন্দর পৃথিবীতে। চারপাশে তাকিয়ে দেখুন ভালো লাগানোর মতো অনেক উপাদান পাবেন। জৈব যৌগের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া থেকে নতুন যৌগ তৈরি হওয়া দেখতে ভালো না লেগে আপনার যদি ছোট্ট কলি থেকে ফুল ফোটা দেখতে ভালো লাগে, তবে বাগান সাজাতে লেগে যান এখনই। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কোনো দিন, ক্ষণ বা সময়ের হিসাব গুরুত্বপূর্ণ নয়; বরং ভালোভাবে বেঁচে থাকতে ঘুরে দাঁড়ানোটা জরুরি।

যা বলা হয়নি
আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো মন যা বলে তা-ই করুন। তাহলেই সফলতা আসবে। তবে অবশ্যই পরিশ্রমী হতে হবে, থাকতে হবে অধ্যবসায় আর যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে শান্ত রাখার ক্ষমতা। জীবনে উত্থান-পতন খুবই স্বাভাবিক। তাই স্বাভাবিককে স্বাভাবিকের মতোই ভাবুন। বেশি দুশ্চিন্তা করে কেউ কখনো কোনো দিন উপকৃত হতে পারেনি, আর পারবেও না। নিজেকে বিশ্বাস করুন সবার আগে। আপনি যা পারেন, তা শুধু আপনিই জানেন। আপনার প্রতিভা অন্য কেউ টেনে বের করতে পারবে না। নিজেই নিজেকে সাহায্য করুন। নিজেই নিজের কাউন্সেলর হয়ে উঠুন। আর চেষ্টা করুন অন্যকে জীবন উপভোগ করতে সাহায্য করার। সফলতা আর কিছুই নয় বরং খুশি থাকা, আনন্দে থাকা, ভালো থাকা। ভালো থাকুন ও ভালো রাখুন। শেষ করব আমার প্রিয় শিক্ষক ও প্রিয় মানুষ সুব্রত ভট্টাচার্যের কয়েকটি অসামান্য উক্তির সামান্য অংশ দিয়ে, যা আমি আমার একমাত্র ছাত্রের বইতেও লিখে রেখেছি, ‘সুন্দর হও সুন্দর করো।’

লেখক: সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, ইউল্যাব

প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের প্রকাশনা ‘তারুণ্য’, সপ্তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৮ থেকে নেওয়া।