বাংলা নববর্ষের ভোজনবিলাস

লেখাটি ২০২৪ সালের জুনে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের দশম সংখ্যা থেকে নেওয়া।

অলংকরণ: অভিনয় আহমেদ

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রাচুর্যের মানদণ্ডে একটি জাতির ভিত নির্ধারিত হয়, সংস্কৃতি যেখানে সেই জাতির অন্যতম পরিচায়ক। ভোজনরসিকতা যেমন মিশে আছে আপামর বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে। এই বাংলার উর্বর মাটিতে শত বছর ধরে জন্মেছে ধান আর বহু নদী-খাল-বিলে মিলেছে মাছ—বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে মাছ-ভাতের সম্পর্ক সেই হিসাবে ঐতিহাসিক। ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’র পরিচয় সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলেছেন, ‘ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল,/ ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।’ ইতিহাসও তা–ই বলে, প্রাচীন পুণ্ড্রনগরে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয়-তৃতীয় শতকে মৌর্য শাসনকালে খাদ্যাভাব দূর করতে ধান বিতরণ চালু হয়। আবার ভারতবর্ষে পাওয়া মাছের ফসিলের বয়স কোনোটার ১৮ কোটি বছর তো কোনোটার ৩০ কোটি বছর। বাঙালি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম এই পরিচায়ক মাছ-ভাত মিশে গেছে উৎসবের সঙ্গেও। বাংলা নববর্ষের যোগসূত্র যেমন পান্তা-ইলিশের সঙ্গে। বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনের কথা মনে হতেই আমাদের উন্নত মস্তিষ্ক জানান দেয় লালপাড়ের সাদা শাড়ি, পাঞ্জাবি আর পান্তা-ইলিশের। পান্তা-ইলিশ যেন বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে পান্তা-ইলিশ ও বাংলা নববর্ষের ঐতিহাসিক সম্পর্ক নিয়ে বেশ মতভেদ লক্ষ করা যায়। কেউ কেউ এই সম্পর্ককে মেলাচ্ছেন সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ববাদের সঙ্গে।

২.

যেকোনো সমাজেই সাধারণত দুটি শ্রেণি থাকে—শাসক ও শোষিত। শাসক শ্রেণির চর্চা করা বিভিন্ন মতবাদ, বিশ্বাস, চিন্তাধারা ও নিয়মকানুন দ্বারা সমাজ পরিচালিত হয়; সামাজিক জীব হিসেবে শোষিত শ্রেণি ওই সব মতবাদ, বিশ্বাস, চিন্তাধারা ও নিয়মকানুন পালনে বাধ্য হয়। একটি শ্রেণির ওপর আরেকটি শ্রেণির এই শাসনকে আমরা আধিপত্য বা কর্তৃত্ববাদ নামে চিনে থাকি।

সমাজের অন্যতম অংশ হিসেবে ‘সংস্কৃতি’ও এর বাইরে নয়; যেমনটি বলেছেন ইতালিয়ান দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামসি। গ্রামসির ‘প্রিজন নোটবুকস’ যেগুলো তিনি ১৯২৯-৩৫ সালের মধ্যে লিখেছেন, সেগুলো ঘাঁটলে দেখা যায়, সংস্কৃতির কর্তৃত্ববাদ কীভাবে সমাজে মিশে আছে। তিনি বলেছেন, সমাজে সেই নিয়মকানুন ও চিন্তাধারাই প্রচলিত, যেগুলো শাসক শ্রেণি বিশ্বাস করে ও মেনে থাকে। তিনি বলেন, এই মতবাদ, বিশ্বাস, চিন্তাধারা ও নিয়মকানুন প্রচার হয়ে থাকে সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান; যেমন স্কুল, চার্চ, আদালত, গণমাধ্যম দ্বারা যেগুলো আবার পরিচালিত হয় ওই শাসক শ্রেণি দ্বারা। এই সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ববাদও মিশে গেছে বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম উৎসব বাংলা নববর্ষের সঙ্গে।

৩.

শাসকশ্রেণির সুবিধার্থেই যে বাংলা সনের গণনা শুরু, সেটি না মানার উপায় নেই। বাংলা অঞ্চল তখন হিজরি সনে পরিচালিত হতো। কিন্তু বাংলা ছিল কৃষিপ্রধান। ফলে খাজনা দেওয়াসহ নানা কাজে বছরের শুরুটা হিসাব করতে সমস্যা হতো। এ কারণেই সম্রাট আকবর তখন বাংলা সন প্রবর্তন করেছেন, পয়েলা বৈশাখ দিয়ে যার শুরু; যেটি ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এর পরদিন অর্থাৎ পয়েলা বৈশাখে ভূমির মালিকেরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন এবং এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসব একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়; যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এ পর্যায়ে এসেছে।

১৯১৭ সাল থেকে আধুনিক নববর্ষ উদ্‌যাপন সম্পর্কে জানা যায়—প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পয়েলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৩৮ সালেও একই কর্মকাণ্ডের উল্লেখ পাওয়া যায় এবং ১৯৬৭ সাল অব্দি পয়েলা বৈশাখ উদ্‌যাপন তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। ১৯৬৭ সাল থেকেই রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা হয় এবং ১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা হয়।

বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনের সঙ্গে পান্তা-ইলিশের সম্পর্ক একেবারেই নবীন। এ নিয়েও অনেক মতভেদ লক্ষণীয়; যেখানে দুজন গণমাধ্যমকর্মীর নাম জড়িয়ে আছে। জানা গেছে, আশির দশকে তথা ১৯৮৩ সালের চৈত্রের কোনো এক বিকেলে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন সাংস্কৃতিক কর্মী; তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন সাংবাদিক বোরহান আহমেদ। তিনিই রমনার বটমূলে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার প্রস্তাব দেন এবং প্রস্তাবে রাজি হয়ে তাঁর সহযোগীরা মিলে পাঁচ টাকা করে চাঁদা তুলে পুরো আয়োজনের ব্যবস্থা করেন। বাজার করা হলো, রান্না হলো, রাতে ভাত রান্না করে পান্তা তৈরি করে তাতে কাঁচা মরিচ-শুকনা মরিচ, পেঁয়াজ ও ইলিশ ভাজা নিয়ে পরদিন বৈশাখের ভোরে হাজির হলেন বটমূলের রমনা রেস্টুরেন্টের সামনে। আর সেই প্রথমবার মুহূর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় সব পান্তা-ইলিশ। অন্যদিকে সাংবাদিক শহিদুল হক খান নিজেকেই এর উদ্যোক্তা বলে দাবি করেন। এ বিষয়ে বিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন, নিজ হাতে পান্তার পোস্টার লিখেছেন, তাঁর পরিবারের সদস্যরা ভাত রেঁধেছেন, ইলিশ মাছ ভেজেছেন, কাঁচা মরিচ পেঁয়াজ কেটেছেন, মাটির শানকি সংগ্রহ করেছেন। আর তখন থেকেই নাকি রমনার বটমূলে খাওয়া শুরু হয় পান্তা ইলিশ। তবে বলা হয়ে থাকে, শহিদুল হক সাংবাদিক বোরহানের করার দুই বছর পর থেকে নিয়মিত পয়েলা বৈশাখে পান্তা ইলিশের আয়োজন করেন। সেই হিসাবে পয়েলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার এই রীতির প্রবর্তক বলা যায় সাংবাদিক বোরহান আহমেদকেই।

৪.

ঐতিহাসিকভাবেই বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মাছ-ভাতের সম্পর্ক; নববর্ষ উদ্‌যাপনের সঙ্গে ইলিশ মাছের প্রচলন বেশ নবীন হলেও পান্তা ভাত সব সময়ই বাঙালি কৃষকের কাছে পরিচিত খাবার। এর সঙ্গে বিভিন্ন শাকসবজি ও শুঁটকি ভর্তা ছিল খাবারের তালিকায়। কিছু এলাকায় কচুশাকের ডাঁটা মিশিয়ে রূপচাঁদা মাছের শুঁটকির প্রচলন বেশি ছিল বলে জানা যায়। বাংলা নববর্ষের সঙ্গে যেমন গ্রামীণ মেলা, নৌকাবাইচ, হইহুল্লোড় করা গ্রামের পরিচিত দৃশ্য আবার ঐতিহ্যবাহী খাবার হিসেবে মেলায় মাছ, গরু, পাখি, ঘোড়ার আদলে মিষ্টি বা মণ্ডা, বাতাসা, জিলাপি আর রসগোল্লার দোকান, তেমনি পান্তা-ইলিশও বাঙালি সাংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি অন্যতম পরিচায়ক; যা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ওপার বাংলাতেও গেছে। সারা বছরের অপেক্ষার পালার পর দুমুঠো পান্তায় পোড়া শুকনা মরিচ ভেঙে ভাজা ইলিশের স্বাদ না নিলে বাঙালিয়ানা থাকল কোথায়!

উপদেষ্টা (২০২২–২০২৩), বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ