ফিরে এসো, বাবা!

ফিরে এসো, বাবা!ছবি: সংগৃহীত

স্তব্ধ পরিবেশ। চারদিকে ভীষণ ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আজ মন ভালো নেই। বারান্দার চেয়ারটায় বসে আছি। হঠাৎ দেখি, পথের ওই দূর প্রান্তে কুয়াশার আড়ালে বাবা আমাকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে। আর বলছে, ‘কিরে মা, তোর মন খারাপ?’ আমি নিদারুণভাবে বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘এত দিন কোথায় ছিলে? বাবা, তুমি আর যেয়ো না, এবার থেকে যাও।’

তাকে নিয়ে দেখা এটাই আমার শেষ স্বপ্ন ছিল। আজ আর মন খারাপ হলেও বাবা এসে বলে না, ‘কিরে মা, মন খারাপ তোর?’

বাবা আজ নেই। ছোটবেলা থেকেই সে ছিল সবচেয়ে কাছের মানুষ। ছুটির দিনগুলো ছাড়া বাবার সঙ্গে খুব বেশি দেখা হতো না। তবু সে আমার মন খারাপের সময়গুলোতে মাথায় হাত বুলিয়ে কারণগুলো শুনত। বলত, ‘চল মা, ছাদে গিয়ে গল্প করি।’ আমিও তার সঙ্গে ছাদে গিয়ে চাঁদের মৃদু আলোয় বসে গল্প করতাম। বাবার সঙ্গে শেষবার যেদিন ছাদে গিয়েছিলাম, সেদিন গল্প করতে করতে মানুষটা হঠাৎ আমাকে বুকে জড়িয়ে ভীষণ কান্না করে এবং বলেছিল, ‘মা দেখ, আকাশটা ভীষণ মেঘলা।’

আকাশের মন খারাপ হলে তার বুকে মেঘ জমে, সেদিন বাবার কথার অর্থ বুঝতে পারিনি। এখন বুঝতে পারি, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। বাবা সেদিন আরও বলেছিল, ‘কখনো জীবনের কাছে হার মানতে হয় না। সবর্দা এগিয়ে যেতে হয়।’

সেদিন রাতে মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত ছিল। হঠাৎ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। আমি পাশে বসে বাবার মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে জল বেয়ে পড়া চোখ দেখছিলাম। মাকে কাঁদো গলায় জিজ্ঞাসা করি, ‘মা, বাবার কী হয়েছে?’ মা জবাবে আমায় কিছু বলেনি সেদিন। শুধু জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে।

সকালে উঠে দেখি বাবা আর নেই। নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি, কেঁদে ফেললাম। হঠাৎ বাবার বলা শেষ কথাটা মনে পড়ল। তার চোখের নিচে কালি জমেছে, হাতটা ভীষণ শক্ত। মানুষটা সারা জীবন আমাদের জন্য কত কষ্ট করে গেছে; তবু খানিকটা কষ্টও বুঝতে দেয়নি।

সেদিন বাবাকে বারবার বলেছিলাম, আর একটা বার ফিরে এসো, বাবা ফিরে আসেনি। টাকার অভাবে তার চিকিৎসা করা হয়নি। আজ আমার অনেক টাকা, শুধু চিকিৎসা করার জন্য বাবাটা নেই। তার হাসিমুখ, মন খারাপের সময় আমার মাথায় বুলিয়ে দেওয়া হাত, কখনো কখনো ছাদে করা সেই গল্প, ছোটবেলায় হাত ধরে রাস্তা দিয়ে হাঁটা আর অঙ্কের নামতা শেখা—সবকিছুই আজ স্মৃতি।

বাবাকে ভীষণ ভালোবাসি, এ কথাও কখনো বলা হয়নি। বাবাকে জড়িয়ে ধরে যে কথা বলতে পারিনি, তা আজ বলতে ইচ্ছা করে প্রতিটি ক্ষণে, প্রতিটি মুহূর্তে।

মিরপুর ১, ঢাকা