মণিকোঠায়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দুপুরের খাবার গ্রহণ শেষে বিছানায় গড়াগড়ি করছে মিনি। আজ তার মন খারাপ। চারদিকের অরাজকতায় দুশ্চিন্তা বেড়ে যাচ্ছে। মিনির ছেলেমেয়েরা এখন বেশ বড়। কর্মব্যস্ততায় দিন কাটায়। সন্তানেরা বড় হয়ে গেলেও মায়ের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সবাই ঘরে না ফেরা পর্যন্ত তার স্বস্তি মেলে না।
মিনির ফোনটি ক্রিং করে বেজে উঠল। ফোনটি রিসিভ করে সে। অপর প্রান্তের ব্যক্তি কোনো কথা বলছে না। মিনি বারবার হ্যালো হ্যালো করে রং নম্বর ভেবে রেখে দেওয়ার জন্য উদ্যত হয়। এমন সময় অপর প্রান্ত থেকে একজন বয়স্ক পুরুষের ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে এল—
—হ্যলো!
—কে বলছেন প্লিজ? মিনি বলল।
—আপনি মিনি বলছেন?
—জি বলছি!

কয়েক যুগ পর মিনি নিজের ডাকনামটি কারও মুখে শুনতে পেল। বয়স বেড়েছে বলে এখন আর কেউ এই নামে ডাকে না। কর্মস্থলে ভালো নাম, মানে কাগজে তুলে রাখা নামেই ডাকে সবাই। শ্বশুরবাড়ির সবাই তাদের সম্পর্কিত নামে ডাকে। আর স্বামী! সে কোনো দিনও ভালোবেসে মিনি বলে ডাকেনি। বরং এই যে শুনছনি, গেলে কই, খোকার মা বলে ডাকে। এসব বাহারি নামের আড়ালে হারিয়ে গেছে তার সুন্দর নামটি।
এ নিয়ে মিনির কোনো আক্ষেপ নেই, বরং এখন তা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তি তার বাবার বাড়ির কেউ, এটা বুঝতে বাকি রইল না। তবুও জিজ্ঞেস করল—
—কে বলছেন প্লিজ?
—আপনার নাম মিনি হলে তুমি করে বলতে চাই।
—তা না হয় বলবেন, কিন্তু পরিচয়টা আগে দেবেন তো!
—তোমাদের পাশের গাঁয়ে আমার বাড়ি। এখন আমি প্রবাসে থাকি।
মিনি কান থেকে ফোনটি নামিয়ে দেখল বাংলাদেশি নম্বর।
—দয়া করে আপনার নামটি বলুন।
—কবির, তোমাদের বাড়িতে মাঝেমধ্যে যেতাম। মনে আছে?
—থাকবে না কেন?
—এবার তোমাদের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পেলাম না। তাই অনেক চেষ্টা করে তোমার নম্বর জোগাড় করেছি।
—তাই নাকি, কেমন আছেন আপনি? কবে এসেছেন দেশে?
—ভালো আছি, এক মাস আগে এসেছি। কেন জানি তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হলো।

অতঃপর আলাপ শুরু। কার কতজন ছেলেমেয়ে। কে কী করে। কোথায় কে সেটেল হয়েছে। কার কী শিক্ষাদীক্ষা। কার কত বয়স হলো। এসব।
—আচ্ছা! তোমার বিয়ে হলো কত বছর হবে?
—তা চল্লিশের কাছাকাছি।
—তোমার চুল পেকেছে মিনি?
—পাকবে না? অবসরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। দূর থেকে শরীরে উঁকি মারছে নানান ব্যাধি।
—তোমাকে দেখেছি অনেক দিন হয়ে গেল, তাই না?
—হুম।
দীর্ঘ আলাপে বেরিয়ে এল ভালো আছে দুজনই। কবিরের বয়স ৭০ পেরিয়ে গেছে। বছর ছয়েক হলো স্ত্রী গত হয়েছে ক্যানসারে। সন্তানেরা যার যার মতো সুখে আছে। বয়স বেড়েছে, কিন্তু বুড়ো হয়নি মন।
—কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি তোমায়।
—বলেন। এতে মনে করার কী আছে।
—একসময় মনে হতো তুমি সেই নাটোরের বনলতা সেন। তোমাকে একনজর দেখার জন্য বিভিন্ন বাহানায় তোমাদের বাড়িতে যেতাম। কিন্তু দারিদ্র্য আমাকে মুখ খুলতে দেয়নি। যার মূল্য দিয়েছি চোখের জলে। অনেক কষ্টে লেখাপড়া শেষ করেছি। একদিন ডিভি লটারি আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন করে দেয়। সেই থেকে যুক্তরাষ্ট্রে।

চুপ হয়ে গেল মিনি। বুঝতে বাকি রইল না মিনিকে সে খুব পছন্দ করত এবং ভালোবাসত। মুখ ফুটে বলা হয়নি কোনো দিন। তার আচরণেও তা প্রকাশ পায়নি কখনো। এটা ছিল ভালোবাসার সম্মান। না বলা কথা বুকে চেপে কেটে গেল দীর্ঘ সময়। মিনি এখানেই কথা সমাপ্ত করতে চাইল। তাই বুদ্ধি করে বলল—
—বাসায় বেড়াতে আসেন।
—না না, তোমার বাসায় আসব না। পাকা চুলে আমি তোমাকে দেখতে চাই না। কবিরের জবাব। আমার স্মৃতিতে ভেসে আছে তোমার আনমনা উদাসী হরিণী দুটি চোখ, এলোকেশী এক ষোড়শী। তুমি আমার মনে তেমনই থাকো।
একপর্যায়ে ফোনালাপ শেষ হলো। মিনি তখন মনে মনে ভাবতে থাকে কত বিচিত্র এ জগৎসংসার। কাছে থাকা মানুষ সব সময় আমাদের বিরক্তির কারণ হয়। একে অপরকে কটাক্ষ করে। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, ঝগড়া করে। কেউ কারও আপন হতে চায় না। কেউ কারও মনের আবেগ, চাওয়া–পাওয়া ও কষ্ট বোঝার চেষ্টা করে না। কাছে থাকা মানুষের মূল্যায়ন করতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। আবার মনের অজান্তে কেউ কেউ বাস করে অন্যের মনের মণিকোঠায়।