অপরের প্রশংসা করুন

কাজ নিয়ে উদ্বিগ্ন হলে তা সহকর্মীদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। ছবি: অধুনা

তরুণদের সব সময় চারপাশের পরিবেশ আর প্রতিবেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হয়। তখন তারুণ্যের ভাবনাচিন্তা ও ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার আচরণের মধ্য দিয়ে। আগামী দিনের পৃথিবীর উপযোগী তরুণদের এই আচরণ হতে হবে স্মার্ট ও পরিশীলিত। তাঁর আচরণে দৃঢ়তা থাকবে, কিন্তু রূঢ়তা নয়। তার আচরণ হবে সময়োপযোগী অথচ স্থিতধী, হঠকারিতা থেকে অনেক দূরে।

প্রিয়জনের সঙ্গে, সহকর্মীর সঙ্গে, অচেনা পরিবেশে, অফিসে, রাস্তায়, টিকিটের লম্বা লাইনে, রেস্তোরাঁয়, খেলার মাঠে, পোশাক-পরিচ্ছদে, মুঠোফোনে কথা বলার সময়, ভাষার ব্যবহারে, দেহভঙ্গিতে, সিঁড়িতে, লিফটে; এমনকি শৌচাগার ব্যবহারেও তরুণদের সঠিক আচরণবিধি মেনে চলা প্রয়োজন। পরিবার থেকে একধরনের আচরণবিধি শেখানো হয়, স্কুলে সে কিছু বিধি রপ্ত করে, কাজ করতে করতে এবং অপরেরটা অনুসরণ করেও আচরণের ইতিবাচক পরির্তন আনা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, কোথায় সে কী ধরনের আচরণ করবে, তা সব সময় কোনো বইয়ে লেখা থাকবে না—সবকিছু পরিবার বা স্কুলে শেখাবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সবচেয়ে যৌক্তিক আচরণ করাটাই কিন্তু স্মার্টনেস। বিনয়ী অথচ ঋজু, নিয়মানুবর্তী অথচ প্রয়োজনে পরিবর্তনশীল আচরণ করতে হবে তারুণ্যকে। কোনো সুনির্দিষ্ট আচরণ বিধিমালা নয়, তারুণ্যের আচরণ নির্ধারণ করতে হবে তরুণদেরই, নিজস্ব সংস্কৃতি আর মূল্যবোধকে মাথায় রেখে।

অনেক সময় কোনো তরুণ মনে করতে পারে যে কেবল রাগ আর ক্ষোভ প্রকাশ করার মধ্যেই নিজের সব ক্ষমতা নিহিত, আবার কখনো মনে হতে পারে, যেসব ক্ষেত্রে মাটির অবতার হয়ে থাকাটাই বোধ হয় ভালো। প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান বলে, মানুষের যত মৌলিক আর মিশ্র আবেগ রয়েছে, যেমন আনন্দ, ভালোবাসা, করুণা, দুঃখ, হতাশা, হিংসা, রাগ, ক্ষোভ—সবকিছুর যৌক্তিক ও পরিমিত প্রয়োগ থাকতে হবে একজন মানুষের আচরণের মধ্যে। বিষয়টি মাথায় রেখেই নিজের আচরণ তৈরি করবে আগামী দিনের তরুণেরা।

কেমন হবে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে একজনের আচরণ? এককথায় এ প্রশ্নের সর্বজনীন উত্তর নেই। সেই পরিবর্তিত পরিস্থিতি, নিজস্ব সংস্কৃতি আর স্বকীয়তাবোধই নির্ণয় করবে আদর্শ আচরণ। আদর্শ আচরণের জন্য কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন—

সব সময় আমিত্ব নয়
সবকিছুতেই ‘আমি–আমি’ করা স্মার্ট আচরণ নয়। নিজেকে মেলে ধরতে হবে তো বটেই, কিন্তু তা যেন প্রকট ও দৃষ্টিকটু না লাগে। অন্যের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে বেশি করে।

পরিস্থিতিকে বুঝতে শিখুন
আরিচা ফেরিঘাটের রেস্তোরাঁয় খেতে বসলে আপনি ছুরি-কাঁটা ব্যবহার করবেন কি না, সে ভাবনাটা আপনাকেই ভেবে নিতে হবে।

পোশাককে গুরুত্ব দিন
পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে গলায় টাই পায়ে শু থাকলে আপনাকে মোটেই স্মার্ট বলা যাবে না, আবার কোনো অফিসে চাকরির সাক্ষাৎকারে টি-শার্ট আর শর্টস পরে উপস্থিত হলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা আছে।

গ্রুমিং
আপনার চুল কাটার স্টাইল, কথা বলার ভঙ্গি, ননভার্বাল কমিউনিকেশন হতে হবে পরিবেশের সঙ্গে মানানসই। এক পরিবেশে যা স্মার্টনেস, অন্য পরিবেশে তা-ই হতে পারে মূর্খতার পরিচয়।

অনুশীলন
আপনার আচরণগুলো কিন্তু হঠাৎ জরুরি পরিস্থিতির জন্য জমিয়ে রাখবেন না। আপনি যদি নিয়মিত এগুলো অনুশীলন না করেন, তবে জরুরি সময়ে কখনোই সঠিক আচরণটি করতে পারবেন না।

পরিবর্তন আনুন আপনার ধারণার জগতেও
নিজের মনকে ইতিবাচক আচরণের উপযোগী করে পরিবর্তন করতে না পারলে, আপনার ধারণার জগৎকে পাল্টাতে না পারলে কেবল কায়দার মেকি আচরণ একসময় আপনার অন্তঃসারশূন্যতাকে প্রকাশ করে দেবে। তাই আচরণের সঙ্গে সঙ্গে মননেও পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।

কোনো মন্দ অভ্যাস থাকলে তা প্রকাশ করবেন না
যদি আপনার কোনো মন্দ অভ্যাস থেকেই থাকে, তবে সেটা পরিত্যাগ করার চেষ্টা করুন। আর পরিত্যাগ করতে পারার আগপর্যন্ত তা প্রকাশ না করার চেষ্টা করুন।

কণ্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণ করুন
যখন জোরে কথা বলার প্রয়োজন নেই, তখন কণ্ঠস্বরকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন। তবে উচ্চকণ্ঠের প্রয়োজন হলে কখনোই বিড়বিড় বা মিনমিন স্বরে কথা বলবেন না।

রূঢ়তা বা আস্ফালন নয়
আপনার পেশিতে শক্তি থাকলেই অযথা রূঢ়তা প্রকাশ করবেন না, বিনা কারণে আস্ফালন করার প্রয়োজন নেই।

সঠিক ভাষার ব্যবহার
যে ভাষাতেই কথা বলুন না কেন, সঠিকভাবে ভাষার ব্যবহার করুন। শব্দ প্রয়োগে সচেতন হোন এবং অবশ্যই যথাসম্ভব শুদ্ধ উচ্চারণ করতে শিখুন।

ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থনা করুন
যেকোনো কাজে ভুল হতেই পারে। ভুল হলে বিনয়ের সঙ্গে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে পারেন, শুধরে নিতে পারেন ভুলগুলো।

আর কিছু ক্ষেত্রে আচরণের পরিবর্তনটি অতি জরুরি। সে জন্য চাই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, লম্বা লাইনের মধ্যে মেরে-কেটে বা অন্যকে ম্যানেজ করে কৌশলে লাইনের সামনের দিকে চলে আসাটাকে অনেকেই মনে করেন বিরাট সাফল্য, যেন তিনি কোনো রাজ্য জয় করে ফেলেছেন। কিন্তু এই আচরণ অত্যন্ত গর্হিত। তারুণ্যের জন্য অবমাননাকর। এটি বুঝতে পারাটাই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। সাধারণত যেসব বিষয়ে আচরণ পরিবর্তনের জন্য তরুণদেরসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হচ্ছে—

গণপরিবহনে বসার সময় অপরের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, তা বিবেচনা করা; জোরে কথা বলা থেকে বিরত থাকা; নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের যথাযথ সম্মান দেওয়া।
কোনো টিকিট বা ব্যাংকের লাইনে কখনোই কৌশল করে সামনে চলে না যাওয়ার চেষ্টা করা।
মুঠোফোনে কথা বলার সময় কণ্ঠস্বর সংযত রাখা, নিজেকে জাহির করার চেষ্টা না করা, মুঠোফোনে মিথ্যা কথা না বলা।
নিজের বদলে অপরকে সুযোগ দেওয়া এবং দলগতভাবে কাজ করার সময় ‘আমি’র বদলে ‘আমরা’ হিসেবে অভিহিত করা।
অপরকে খাদ্য পরিবেশন করার সুযোগ নেওয়া এবং রুচিসম্মতভাবে খাদ্য গ্রহণ করা, খাদ্যের অপচয় না করা।
সময়ানুবর্তী হওয়া। কাউকে সময় দিলে যথাসময়ে উপস্থিত হওয়া এবং কোনো কারণে বিলম্ব হলে তাঁকে আগেই জানিয়ে দেওয়া। কেউ আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলে তাঁকে অযথা বসিয়ে না রাখা, পারলে নিজে গিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করা।
নিয়মমাফিক শৌচাগার ব্যবহার করা, নতুন কিছু বুঝতে না পারলে অপরের সাহায্য নেওয়া। পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, অফিসে বা বাইরের শৌচাগারে অতিরিক্ত পানি নষ্ট না করা, অযথা আওয়াজ না করা এবং শৌচাগারে বসে টেলিফোনে কথা না বলা।
অপরের প্রশংসা করা এবং ধন্যবাদ দিতে শেখা।
কথা বলার সময় শ্রোতার চোখের দিকে তাকানো এবং মৃদু হাসতে শেখা। মোদ্দাকথা, স্মার্ট তরুণকে তাঁর নিজের আচরণ সম্পর্কে সব সময়েই সচেতন থাকতে হবে এবং আদর্শ আচরণ চর্চা করার অভ্যাস রাখতে হবে। আর আদর্শ আচরণ রপ্ত করার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই।

লেখাটি ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের পঞ্চম সংখ্যা থেকে নেওয়া।

অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং উপদেষ্টা, বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ