টুয়েলভথ ফেল: অনুপ্রেরণার মুখোশের আড়ালে

‘টুয়েলভথ ফেল’ সিনেমার দৃশ্যআইএমডিবি

‘টুয়েলভথ ফেল’ নাম শুনেই বোঝা যায়, ব্যর্থতা ঘিরে গল্প। সিনেমাটা দেখতে বসে মনে হতে পারে, এ যেন এক পরিচিত গল্প। সিনেমার অভিনয় বেশ ভালো। সবচেয়ে বড় কথা, এটি সত্য ঘটনা থেকে তৈরি। ভারতের এই পরীক্ষার সঙ্গে বাংলাদেশের বিসিএস পরীক্ষার আশ্চর্য মিল। তাই বাংলাদেশের দর্শকও সহজেই রিলেট করতে পারছেন।

গল্পের শুরুটা হয় এক সৎ কেরানিকে ঘিরে, যে সততার জন্য চাকরি হারায়। তার ছেলে একজন নকলবাজ। কিন্তু জীবন বদলায় এক সৎ পুলিশ কর্মকর্তার কথা শুনে। ছেলেটি নকল ছেড়ে সৎভাবে পরীক্ষায় পাস করে পুলিশ হতে চায়। যদিও সেই সৎ পুলিশকেও বদলি হতে হয় ঠিক পরদিনই—যেন সততার অদ্ভুত শাস্তি।

এর পরের গল্প খুবই পরিচিত। দারিদ্র্য, সংগ্রাম, কঠোর পরিশ্রম। খেয়ে না খেয়ে বেঁচে থাকা, টয়লেট পরিষ্কার, বই মুছে পড়া—সবই একসঙ্গে চলছে। তিনবার পরীক্ষায় ফেল করে। চতুর্থবার, শেষ সুযোগে সে পাস করে। এএসপি (বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বললে) হয়। এই পুরো যাত্রায় পাশে থাকে এক প্রেমিকা, যে ভালোবেসে শক্তি জোগায়, পাশে থাকে কঠিন সময়ে। শেষে—পরীক্ষা পাস, বিয়ে, সুখের জীবন।

সবাই সিনেমার নায়কের মতো পরীক্ষায় টিকবে না, প্রেমিকাকে বিয়ে করে সুখের জীবন গড়বে না। কেউ কেউ হয়তো নিজে ব্যর্থ হয়েও অন্যের জীবন সহজ করে, তারপর নিঃশব্দে মারা যাবে।

সবাই সিনেমা দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। শেখার বিষয়ও খুব স্পষ্ট—‘কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, সত্যবাদী হতে হবে, জীবন আনফেয়ার হলেও চেষ্টা ছাড়লে চলবে না।’

কিন্তু সিনেমার এই অনুপ্রেরণার আড়ালে যে অন্ধকার গল্পটা লুকানো থাকে, সেটি অনেকেই বুঝতে পারেন না। এই সিনেমা আমাদের বলে, জীবনে সব সময় অন্যায় থাকবে। থাকবে অসৎ রাজনীতিবিদ, যারা নকলের উৎসব করবে, তোমার মতো সাধারণ মানুষকে ঠিকঠাক ব্যবসা করতেও দেবে না। থাকবে অসৎ পুলিশ, যারা তোমার পথে বাধা হবে। তোমার বাবা বিচার পেতে বছরের পর বছর আদালতের দ্বারস্থ হবে, কিন্তু বিচার আসবে না। তবু তোমাকে সৎ থাকতে হবে। সব সময় চেষ্টা করতে হবে। যতই কষ্ট হোক, আটার মিলে ১৬ ঘণ্টা খেটে হলেও লড়ে যেতে হবে। তাহলেই তুমি হয়তো একদিন সফল হবে।

সিনেমার আড়ালে যে বাস্তবতা দাঁড়িয়ে থাকে, সেটি আরও নির্মম। সিনেমা বলে না, তুমি যে সমাজ বা দেশে থাকো, সেটি বদলাবে না। সেটি সব সময়ই খারাপ থাকবে। ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে সমাজ অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবে। ধনী-ক্ষমতাবানদের জন্য সব সুযোগ ছলে-বলে-কৌশলে বরাদ্দ থাকবে। আর তোমাকে শেখানো হবে—‘সৎ থাকো’, ‘মানবিক হও’, ‘পরিশ্রম করো’। সিনেমা বলে না, তোমার সফল হওয়ার সম্ভাবনা মাত্র ০.১ শতাংশ। তুমি যে চাকরির জন্য দিনরাত পরিশ্রম করছ, সেখানে যারা আগে থেকেই আছে, তারা বেশির ভাগই সৎ নয়, ভবিষ্যতেও হবে না।

হয়তো তুমি এই চাকরি পেয়ে নিজেকে গরিবি থেকে মুক্ত করতে পারো। হয়তো একটা সুন্দর জীবনসঙ্গিনী জুটবে। তোমার বিচার না পাওয়া বাবা তোমার জন্য একটু গর্ববোধ করবে। কিন্তু এর বাইরে তুমি আর কিছুই বদলাতে পারবে না। সিস্টেম তোমাকে একসময় বদলে ফেলবে, অথবা তুমি এই সিস্টেমের সঙ্গে টিকতে না পেরে ছিটকে পড়বে। যদি সেই ০.১ শতাংশ সৌভাগ্যবানদের একজন হতে না পারো, তবে তোমার জীবন যেখানে ছিল, সেখানেই থেকে যাবে। চার বছরের মূল্যবান সময়ও হারাবে, যা হয়তো অন্য কোনো কাজ বা জীবন বদলের পথে কাজে আসত। এটাই বাস্তবতা।

এ সিনেমাগুলো ঠিক এই জায়গায় এসে পাঠক-দর্শকদের ভুলিয়ে রাখে। তুমি মনে করো, দরিদ্রতা তোমার কোনো সমস্যা নয়। তুমি সফল নও, কারণ তুমি যথেষ্ট চেষ্টা করোনি। তোমার সৎ থাকার অভাব, তোমার মেধার ঘাটতি, তোমার দুর্ভাগ্য—সব দায় তোমার কাঁধেই চাপানো হয়। তুমি যে গরিব, তুমি যে সুযোগ থেকে ইচ্ছা করে বঞ্চিত হচ্ছ, সেটা কোনো সমস্যাই নয়। তোমার সঙ্গে অন্যায় করা ধনী-ক্ষমতাবানরা আরামে আছে, সেটাও কোনো ইস্যু নয়। সমস্যা শুধু তোমার ব্যর্থতা।

এই ভাবনায় বেঁচে থাকে ঠিক তারাই, যারা ব্যর্থ হয়, গরিব থাকে, যারা কখনো মেধাবী হতে পারে না, যারা সিস্টেমের দৌরাত্ম্যে আটকে থাকে। কারণ, এদের ছাড়া সিস্টেম চলবে না। তাদের ছাড়া কামলা কে হবে? এই সিনেমাগুলোর খদ্দের কে হবে? সস্তা শ্রম কে জোগাবে? ঘাম দিয়ে বিলাসের কাঁচামাল কে সরবরাহ করবে?

তাই সিনেমা দেখে আনন্দ পেতে পারো, অনুপ্রাণিতও হতে পারো। তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু বাস্তবতা ভুলে যেয়ো না। অন্তত এটুকু মনে রাখো—তুমি অন্যায়ের শিকার। তুমি চেষ্টা করো সফল হতে, কিন্তু সফল না হলে নিজেকে দোষ দিয়ে ধ্বংস হয়ো না। বরং যারা তোমার জীবন কঠিন করে রেখেছে, তাদের দিকে আঙুল তুলতে শেখো। তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর চেষ্টা করো। এটাও একধরনের সফলতা।

সবাই সিনেমার নায়কের মতো পরীক্ষায় টিকবে না, প্রেমিকাকে বিয়ে করে সুখের জীবন গড়বে না। কেউ কেউ হয়তো নিজে ব্যর্থ হয়েও অন্যের জীবন সহজ করে, তারপর নিঃশব্দে মারা যাবে। সে-ই আসলে সত্যিকারের সফল মানুষ। কিন্তু আমরা তাকে মনে রাখব না। মনে রাখব উর্দি পরা, পরীক্ষা পাস করা সিনেমার নায়ককে। তারটাই মোটিভেশন। বাকিদেরটা শুধু অবজারভেশন।

সহসভাপতি, বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ