হজরত শাহজালাল (রহ.)–এর মাজার থেকে বের হয়ে আসছিলাম। ওরস চলছে। রাতে আখনি দেওয়া হবে। দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার ভক্ত-অনুরাগী এসেছে। তার চেয়েও বেশি এসেছে ভিক্ষুক আর শারীরিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষেরা।
চারদিকে এত কোলাহল, ব্যান্ডের আওয়াজ আর বাঁশির শব্দ যে কান পাতা যায় না। মাথার ওপর উত্তপ্ত সূর্যের চোখ রাঙানি তো আছেই। এত মানুষের ভিড়ের মধ্যে গরমে প্রায় হাঁসফাঁস অবস্থা। মাজারের প্রধান ফটক পার হওয়ার সময় হঠাৎ চোখে পড়ল একটি ৯-১০ বছরের মেয়ের দিকে।
মাজারজুড়ে শত শত ভিক্ষুক। একটু সাহায্যের জন্য তাদের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। সেখানে মাজারের প্রধান ফটকের পাশে মাটিতে গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন থাকা মেয়েটিকে দেখে থমকে গেলাম। তার চেহারার বিশেষত্ব ও সারল্য ভাব যদি আমার মতো অন্য কেউ খেয়াল করত, তাহলে তারাও থমকে যেত। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।
মেয়েটির শরীরে একটা পুরোনো ময়লা জামা। চুলগুলো পেছনে বাঁধা। তার অপরূপ মুখের গড়নে যে প্রশান্তির ভাব আর স্নিগ্ধতা খেলা করছিল, তা যেন সূর্যালোকের প্রতিফলনের সঙ্গে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু পৃথিবীর মানুষের চোখের সংবেদনশীলতা কমে যাওয়ায় সবার চোখে তা ধরা দিচ্ছিল না। মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলাম। এক হাত মাথার নিচে, ডান কাঁধ হয়ে শুয়ে আছে। দুই পা মোড়ানো। ডাকতে গিয়েও ডাকলাম না। চেহারায় যে মায়ার দ্যুতি জ্বলজ্বল করছিল, তা আমাকে আটকে রাখল। সারা দিনের গভীর কষ্টের মধ্যে এই ক্ষুদ্র সময়টুকু সে যে শান্তির মধ্যে তলিয়ে আছে, তা আর বিনষ্ট করলাম না। দুই ঘণ্টা পর তার ঘুম ভাঙল। উঠে বসে চারদিকে তাকাচ্ছে। চেহারায় আর আগের মতো প্রশান্ত ভাব দেখা যাচ্ছে না। সেই জায়গায় এসেছে বিষণ্ণতা আর সামান্য কিছুটা ভয়।
সূর্য মাথার ওপর থেকে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। সূর্যালোকের রং সাদা উজ্জ্বল বর্ণের পরিবর্তে এখন কিছুটা হলদে। আমি মেয়েটির দিকে এগিয়ে গিয়ে পরিচিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মামণি ভালো আছ?’ সে একটু হকচকিয়ে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আবার বললাম, ‘তোমার কি খিদে লেগেছে, কিছু খাবে?’ সে মাথা নেড়ে সায় দিল।
কিছুক্ষণের মধ্যে বিরিয়ানির একটি প্যাকেট এনে তার হাতে দিলাম। সে হাত না ধুয়েই খেতে শুরু করল। আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে তার খাওয়া দেখতে লাগলাম। এই খাওয়ার দৃশ্য দেখার মধ্যে যে অদ্ভুত আনন্দ আমি পেয়েছি, তা যেন ম্রিয়ওমাণ করে দিচ্ছিল সেই দৃশ্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকা শত অভিযোগ-অভিমান। ছোট্ট শিশুটি মনের আবেগ দিয়ে শিল্পীর তুলির আঁচড়ের মতো করে আমার হৃদয়ে করুণ ছবি আঁকছিল। কিন্তু সেই ছবির হৃদয়বিদারক আর্তচিৎকার আমার অন্তঃকর্ণে ধ্বনিত হয়নি। তার খাওয়া শেষ হয়ে এল। জিজ্ঞেস করলাম,
—কী নাম তোমার?
—রুবিনা।
—কোথায় থাকবে রাতে? তোমার মা–বাবা কই থাকে?
সে কিছু বলল না। কারণ, তার এই প্রশ্নের উত্তর যে জানা নেই।
সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। টিউশনে যেতে হবে। আর বেশিক্ষণ থাকতে পারছিলাম না। বললাম, ‘রুবিনা তুমি থাক, আমি যাই।’ হঠাৎ মেয়েটির চেহারার বিষণ্ণ ভাব যেন আরও বেড়ে গেল। আমি রওনা দিলাম। একবার পেছন ফিরে দেখলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন সে ডাকছে। কিন্তু এই স্বার্থপর সমাজে থেকে থেকে আমিও যে বড়ই স্বার্থপর হয়ে গেছি! তাই তো বাচ্চা মেয়েটিকে খোলা আকাশের নিচে এক ভয়ংকর আর বিভীষিকাময় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে ঠেলে দিয়ে আসতে পারলাম।
শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়