খিড়কি খুলে বসে আছে চন্দ্রাবতী। চাঁদের আলো দেখছে। চাঁদের মধ্যে একটা কী যেন আছে! চাঁদ মানুষকে খুব কাছে টানতে জানে। মানুষকে কাছে টানার এ রহস্য আজও অনির্ণীত। অথচ সে কাউকে তার কাছে ভিড়তে দেয় না। ছুঁতেও দেয় না। জোছনার আলো চন্দ্রাবতীদের এপাড়ায় আসে না। এখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার পায়ে হাঁটে। স্যাঁতসেঁতে গলির এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত বিদঘুটে নোনতা গন্ধ হু হু করে ভাসে। সেই গন্ধে বমির উদ্রেক হয়। চন্দ্রাবতীরা এসব গন্ধটন্ধকে থোড়াই কেয়ার করে! গলায় মাল পড়লে সব এক। কি ময়লার ভাগাড়! কি রজনীগন্ধার সুঘ্রাণ! চন্দ্রাবতীদের শরীর ও মন সবই এক।
দূর থেকে ভেসে আসছে সাবিত্রী মাসির গলা। গলা তো নয় যেন ফাটা বাঁশ। সাবিত্রী মাসি মুখটা হাঁ করলেই ঠাস ঠাস আওয়াজ বের হয়। চন্দ্রাবতীর চার–পাঁচ ঘর সামনেই সাবিত্রীর ঘর। চন্দ্রাবতী খিড়কি দিয়ে মাথাটা সামান্য বের করে ওদিকে কী হচ্ছে দেখার চেষ্টা করছে। না, কিছু দেখা যাচ্ছে না। এপাড়ায় কেউ কাউকে দেখতে পায় না। অথচ কেউ অন্ধ নয়। শুধু একে অপরের গলা শোনে। এদিকে সাবিত্রী মাসির গলার আওয়াজ আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। আওয়াজ ক্রমে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর। মাসি কারও ওপর খেপেছে মনে হয়। আর না হয় মাল একটু বেশিই গিলেছে আজ। কামের ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই তার। শুধু টাকা চাই। আরও বেশি টাকা চাই। প্রথম প্রথম চন্দ্রাবতীর কাছে সাবিত্রী মাসিকে সাক্ষাৎ ডাইনি মনে হতো। তার মনে তিল পরিমাণ দয়ামায়া নেই। সারাদিন মদ গিলে, টাল হয়ে পড়ে থাকে নিজের ঘরে। তার দুই চোখ বন্ধ থাকলেও এপাড়ায় কখন কী হচ্ছে, সবকিছু সে দেখতে পায়। এটা একটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার। এ জন্য মাসির চোখকে ফাঁকি দেওয়ার সাহস কেউ করে না।
‘মাগি, তুই নয়া নাগর জুটাইছত—না! আমার কতা যখন অক্ষরে অক্ষরে ফলব, তহন তুই বুঝবি লো। যখন নাগরডা তরে দাগা দিয়া চইল্যা যাইব, তহন বুঝবি। আরে এইডাই ত তর সময়। কাম কর। টেহা কামা। কিছু টেহাপয়সা নিজে জমা। নাহ্! আমার কতা ত এহন ভাল্ লাগতাছে না। দেখ্, মাগির মনে কত পিরিত; নাগরের লগে হুইয়া হুইয়া জোছনা দেহে।’—কথাগুলো যে চন্দ্রাবতীকে উদ্দেশ করে বলছে, পাড়ার সবাই বুঝতে পারে। তিন বছর ধরে একই গালি একই গল্প শুনে শুনে পাড়ার সবার সয়ে গেছে। সাবিত্রী মাসির গালি শুনে চন্দ্রাবতী মুচকি মুচকি হাসছে। তার কোলে শুয়ে আছে রতন। রতন ড্রাইভার ছয় চাকার ট্রাক চালায়। সারা দেশে মাল টানাটানি করে। প্রতি মাসে সে এপাড়ায় একবার ঢুঁ মারে। তিন–চার দিন থাকে। এই পাড়ায় চন্দ্রাবতী আসার পর থেকেই রতন ড্রাইভার চন্দ্রাবতীর কাছে এসে থাকে। সারা দিনরাত সে চন্দ্রাবতীর সঙ্গ নেয়। একই আবর্তে কেটে গেছে তিন–তিনটা ফাগুন। এভাবেই নিয়ম করে যমুনার জল বয়ে গেছে আরও দক্ষিণে। তারপর হঠাৎ একদিন গাছের পরিত্যক্ত গুঁড়ির মতো চন্দ্রাবতীর মনেও মায়া আসে। রতন ড্রাইভারের জন্যও মায়া জমে তার বুকে। কখনো কখনো সেই মায়া বুকে উতলে ওঠে। তখন সাবিত্রী মাসি হাসাহাসি করে। টিপ্পনী কাটে। অন্য ঘরের নাগরীরাও হাসাহাসি করে। তবু দুর্দান্ত গতিতে জল কেটে এগিয়ে যায় চন্দ্রাবতীর প্রেমের সাম্পান। রতন ড্রাইভারকে নিয়ে সেই সাম্পানে অথৈ সাগর পাড়ি দেয় চন্দ্রাবতী। বালুচরে আশার বসতি গড়ে তোলে। চন্দ্রাবতী কল্পনার ফানুস ওড়ায় আকাশে। তাঁর প্রতিটি শ্বাস–প্রশ্বাসে ছোটাছুটি করে মায়া, ভালোবাসার নিরেট পঙ্ক্তিমালা। চন্দ্রাবতীর কোলে মাথা রেখে রতন ড্রাইভার চোখ বুজে আছে। চন্দ্রাবতী তাঁর চুলে পিলপিল করে বিলি কাটছে।
সাবিত্রী মাসির ঘরে আসার আগে এই চন্দ্রাবতী ছিল গ্রামের সাধারণ একটি মেয়ে। রসুলপুর গ্রামের এক দুরন্ত কিশোরী। জন্মের সময় সে আলোর মতো উজ্জ্বল হয়েছিল বলে তার নানি নাম রেখেছিল দীপালি। সেদিন তার জন্মতিথিতেও নাকি অবাক জোছনা ছিল রাতের আকাশে! লাউফুলের মতো নরম মেয়েটাকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় তার মা। এর পর থেকেই শুরু হয় দীপালির নতুন যাতনা। সৎমায়ের সংসারে আঘাতে আঘাতে বড় হতে থাকে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় সৎমা তার লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়। তাকে পদে পদে অপমানিত হতে হতো। কথায় কথায় খোঁটা দিত সৎমা। অমাবস্যা এলে তার শরীরের প্রতিটি লোমকূপে যন্ত্রণা হয়। প্রতিটি আঘাতের বিবশ যন্ত্রণা। দীপালি পালাতে চায়। দূরে কোথাও পালিয়ে সে বাঁচতে চায়। কিন্তু এত বড় পৃথিবীতেও দীপালির কোথাও কোনো ঠাঁই নেই। তার আপন একটা ঠিকানা নেই।
এক রাতে দীপালি রসুলপুরের করিম শেখের ছেলে শামীমের হাত ধরে ঘর ছেড়ে পালায়। তাদের সম্পর্কের কথা কোনো কাকপক্ষীও টের পায়নি। শামীম ঢাকা শহরের একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করত। ভালোই বেতন। ছোট্ট একটা বাসাও আছে। দীপালি স্বপ্ন দেখে ছোট্ট একটা সংসার হবে। শামীমের হাত ধরে পালিয়ে চৌদ্দ–পনেরো বছর বয়সী দীপালির চোখেমুখে ফুটতে থাকে আনন্দের ফুল। সুখের সুঘ্রাণে সে তখন বিমোহিত এক সত্তা। শহরের সেই ছোট্ট বাসায় শুরু হয় দীপালির নতুন বিষাদনামা। আরেক অধ্যায়ের গল্প। মাসের পর মাস এই ছোট্ট বাসায় দীপালির ওপর চলে শহুরে শকুনদের কামোল্লাস। প্রতি রাতে ঘুঁটে ঘুঁটে রস খেয়ে যায় নাগরিক নাগরেরা। অন্তঃসত্ত্বা নারীর পেটের মতো শামীমের পকেটও ফুলতে থাকে। পুরোনো ঠিকানায় নতুন হুরপরী আসায় দীপালির রেট কমে আসে। একদিন তাঁর ঠাঁই হয় সাবিত্রী মাসির ঘরে। পকেটভর্তি টাকা নিয়ে শামীম ফিরে যায় গ্রামে নতুন দীপালির খোঁজে।
দীপালির আসল নাম মুছে দিয়েছে সাবিত্রী মাসি। চাঁদের মতো সুন্দর বলে মাসি তাঁর নাম দেয় চন্দ্রাবতী। নামটি এই পাড়ায় তিন বছর ধরে হিট। চন্দ্রাবতী এখন আগের মতো সুন্দরী নেই। শ্বেত চামড়ার নিচে মেদ জমেছে। চোখের পাতায় কালি জমেছে। তাঁর কাছে রতন ড্রাইভার আসে না অনেক দিন হয়। তবু কাম চলে। পসরা সাজিয়ে প্রতিদিন কাম চলে। মাটির ব্যাংকে টাকা জমে। সাবিত্রী মাসির আঁচলের গিঁটও বড় হতে থাকে। এখন শুধু চন্দ্রাবতী আর হাসে না। খিড়কি খুলে জোছনা দেখে না। তার নিশ্বাসজুড়ে কেবলই দীর্ঘশ্বাস। পাশের ঘরে নাকি নতুন মেয়ে এসেছে। একদম ইনটেক, ষোড়শী। টাটকা ফুলের গন্ধ নিতে সবারই ভালো লাগে। পাশের ঘর থেকেই রতন ড্রাইভারের গলার মতো শোনা যাচ্ছে। চন্দ্রাবতী ঘরের বেড়ায় কান পাতে। শুনতে পায়, রতন ড্রাইভার নতুন মেয়ের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করছে। প্রতি মাসে তিন থেকে চার দিন সে নতুন মেয়ের কাছে থাকবে।
অন্ধকারের গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে পাড়ার রাত। উন্মাদ হচ্ছে অন্ধকার ঘর ও বিছানা। ওই দিকে গলগল করে আকাশ বেয়ে নামছে জোছনাধারা। আজ চন্দ্রাবতীর ঘরের খিড়কি খোলা নেই। আজ কোনো জোছনা বিলাসও নেই। এই পাড়ায় কেবল ঘুটঘুটে অন্ধকার। স্যাঁতসেঁতে এই অলিগলি। নোনাধরা বালিশে জলের দাগ। অন্ধকার ঘরের তুলতুলে বিছানা শুয়ে আছে চাঁদের কঙ্কাল।
লেখকের ঠিকানা: মাধবপুর, হবিগঞ্জ