সেই আমি নই আমি—হরিশংকর জলদাস

সেই আমি নই আমি—হরিশংকর জলদাস

‘মহাভারত’ বইয়ে অনেক চরিত্র রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো ‘শকুনি’। যে ব্যক্তিটি সম্পর্কে কৌরব বংশের ধৃতরাষ্টের ছেলে দুর্যোধনের আপন মামা, গান্ধারীর আপন ভাই, গান্ধার রাজ্যের রাজকুমার। এই ব্যক্তি কূটকৌশলের জন্য ইতিহাসের পাতায় এখনো বেঁচে আছেন। দাবা খেলায় অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দেওয়া এই ব্যক্তি কথার মায়াজালে যে কাউকে আবদ্ধ করতে পারতেন। বুদ্ধি অনেক থাকলেও জীবনভর সেটার ব্যবহার করেছেন কূটকৌশলে। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ কৌরব ও পাণ্ডবপক্ষের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ। ভালো কোনো কাজে সেটার ব্যবহার করতে পারেননি।

‘সেই আমি নই আমি’ বইটি লেখক হরিশংকর জলদাস সেই শকুনি চরিত্র নিয়েই লিখেছেন। ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষী ব্যাসদেবের রচিত ‘মহাভারত’ থেকে ঘটনা নিয়ে নিজস্ব ভঙ্গিমায় কিছু যোগ করে সৃষ্টি করেছেন বইটি, যা মূলত শকুনি চরিত্রকে বিশ্লেষণ করেছে। এ ছাড়া মহাভারতে শকুনি–সম্পর্কিত ঘটনাগুলো যুক্তিতর্ক উপস্থাপনস্বরূপ তুলে ধরেছেন বাস্তবতার বেড়াজালে।

মহাভারত পড়ে আমি জেনেছিলাম, কৌরবপক্ষ ও পাণ্ডবপক্ষের মধ্যে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়েছিল দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ ঘটনার ওপর ভিত্তি করে। আর এটার অন্যতম কারণ ছিল পাশা খেলায় আয়োজন নিয়ে। যেখানে যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলার জন্য নিমন্ত্রণ দিয়ে আনা হয় এবং দুর্যোধনের হয়ে পাশা খেলা পরিচালনা করেন স্বয়ং শকুনি নিজে। স্বাভাবিকভাবেই শকুনির শঠতা আর কূটকৌশলের কাছে হেরে যায় যুধিষ্ঠিরসহ পঞ্চপাণ্ডব এবং সবকিছু তারা হারায়। আর এই পাশা খেলায় শকুনির জয়ের অন্যতম কারণ তার বাবার হস্তী দিয়ে বানানো পাশার ঘুঁটি, যা তার ইশারায় চলে। এত কিছুর জন্যই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হয়েছিল।

কিন্তু এই বই থেকে জানতে পারলাম, শকুনিকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, তার থেকে সে আরও বেশি চালাক, চতুর ও বিচক্ষণক্ষমতার মানুষ। তার নিজস্ব আলাদা ক্ষোভ ও পরিকল্পনা ছিল কৌরববংশ ধ্বংস করার জন্য। প্রথমত, শকুনি যখন জানতে পারে আদরের প্রিয় বোন গান্ধারীর বিয়ে ঠিক হয়েছে হস্তীনাপুরের অন্ধরাজকুমার ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে এবং তার বাবা রাজা সুবল সে বিয়েতে সম্মতি দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় পেলেন না, তখনই তার মনে কৌরববংশ ধ্বংস করার বীজ রোপণ হয়।
দুর্যোধন ছিল উদ্ধত, বদমেজাজি, একরোখা বৈশিষ্ট্যের। সে কারও কথা না শুনলেও একমাত্র শকুনি মামার কথা শুনত। এই সুযোগটাই নেয় শকুনি। পাশা খেলার আয়োজন করা, পাণ্ডবদের সব সম্পত্তি দুর্যোধনের করে দিয়ে তাদের নিঃস্ব করা, শেষমেশ কৌরবদের শত ভাইয়ের মৃত্যু। এসব ঘটনার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে শকুনি।

বইটিতে হয়তো মহাভারতের শকুনির বৈশিষ্ট্যসহ অনেক কিছু প্রাধান্য পেয়েছে। তবে এসবের মধ্যেও প্রকাশ পেয়েছে আমাদের সমাজের মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মনমানসিকতা। কিছু চরিত্র ইতিহাসের সাক্ষী হলেও তাদের চরিত্রের মাধ্যমেই প্রকাশ পেয়েছে সে সময়কার সমাজ, রাষ্ট্রের শাসননীতি। এভাবেই বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অনেক কিছুই প্রকাশ পাবে ভবিষ্যতের ইতিহাস হয়ে।