সত্য সুন্দর, সত্যই সমৃদ্ধ

প্রতীকীসংগৃহীত
নিজের ভুল স্বীকার করে নেওয়ার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় গুণাবলিটুকুরও অভাব বাজারে। খাপছাড়া যুক্তি দিয়ে হলেও আমরা জিতে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাই। ভুল স্বীকার করে হেরে যাওয়ার মধ্যে যে ক্ষীণ আনন্দ আছে, তা অনুভব করার শক্তি আমরা হারিয়েছি অনেক আগেই।

‘আমার কর্ণধার আমি। আমার পথ দেখাবে আমার সত্য। আমার যাত্রা-শুরুর আগে আমি সালাম জানাচ্ছি, নমস্কার জানাচ্ছি আমার সত্যকে।’ নবম-দশম শ্রেণিতে পাঠ্যবইয়ের সবচেয়ে আভিজাত্যপূর্ণ প্রবন্ধের মধ্যে অন্যতম হলো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘আমার পথ’। এই আভিজাত্যের ভারী শব্দগুলোর সমন্বয়ে লেখা প্রবন্ধ আমরা পড়েছি ঠিকই, তবে তার কতটুকু ধারণ করেছি, সেটিই প্রশ্ন! শতভাগ নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে প্রবন্ধের প্রতিটি শব্দই আমরা মেনে নিয়েছি। তবে কতটুকু অংশ মনে নিয়েছি, সেটি আরও বড় প্রশ্ন!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের গল্প উপন্যাসের শেষ দিকে একটি আলাপনের মধ্যে বড় ধরনের শিক্ষা রয়েছে। তা হলো, মেনে নেওয়া আর মনে নেওয়া এক জিনিস নয়। আজকাল ইতিবাচক ও সত্য অনেক কিছুকে খুব সহজেই মেনে নেওয়া আমাদের যেমন অভ্যাস, তেমনি মনে না নেওয়াও অভ্যাসে রূপ নিয়েছে। সত্যের সহস্র সৌন্দর্যকে আলিঙ্গন করে নিতে বোধ হয় আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি! যদি তা না-ই হতো, তবে মিথ্যের বাজারে এত হাসি-আনন্দের কোলাহল কেন! বাজারে সবকিছুর দাম বাড়লেও মানুষের দাম প্রতিনিয়ত কমছে। মনুষ্যত্ব নামক উপাদানের অভাব হওয়ার পর থেকেই বাজারে মানুষের চাহিদা কমতে শুরু করেছে। দাম বাড়ছে মুখোশের। পৃথিবীতে এত এত মানুষ বানানোর কারখানা, তবু মানুষ খুঁজি। কবি খালেদ হোসাইন তাঁর একটি কবিতায় লিখেছেন, ‘আমার কেবলই মনে হয় প্রতিটি মানুষের বুকের ভেতর লুকায়িত আছে একেকটি শাণিত চাপাতি!’ স্বচ্ছ মানসিকতার সংকটে আজ নিত্যপণ্যের বাজার ভারসাম্য হারিয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে পণ্যের সংকট হতে পারে! তবে স্বচ্ছ মানসিকতার সংকট বাধার বড় কারণ কী!

পৃথিবী যদি একটি নাটকের বাজার হয়, তবে মনুষ্যত্বহীন সেই বাজারের সবচেয়ে বড় অভাব বোধ হয় বিবেক। ফাঁসির আসামির মৃত্যুর আগে যেমন চোখে কালো কাপড় বেঁধে দেওয়া হয়, তেমনি আমাদের চোখেও অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঝাপসা কালো কাপড় বাঁধা আছে। যে কাপড়ের নিচে মানুষের চিন্তাচেতনা, বিবেক-বিবেচনা লোপ পেয়েছে। যদি তা না-ই হতো, তবে দুর্ঘটনায় পড়া কোনো মানুষকে সাহায্য না করে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করার প্রতিযোগিতা কেন হয়! কেন বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে! সম্পর্কের বিচ্ছেদই-বা বাড়ছে কেন! এ সবকিছুর মূলে রয়েছে মিথ্যার আভিজাত্য। সত্যকে কালো কাপড়ে বেঁধে রেখে ঝাপসা হয়ে আসা বিবেককে হত্যার ফলাফল। মিথ্যা বিনয়! মিথ্যা বিনয়ের আরেক নাম মুখোশ। মুখোশের আড়ালে থাকা মানুষ কতটা ভয়ানক হতে পারে, তা কল্পনা করা অসম্ভবপ্রায়!

পৃথিবীতে যত সমৃদ্ধির ইতিহাস রয়েছে, যত অগ্রযাত্রার মহাকাব্য রচিত হয়েছে, যত সফলতা, স্নিগ্ধ এবং সৌন্দর্যের প্রতীক হলো ‘সত্য’। পৃথিবীতে যতবার সত্যের মহাবাণী ধ্বনিত হয়েছে, ততবার শুদ্ধতার প্রকাশ পেয়েছে এবং ইতিহাসের উন্নয়ন নজর কেড়েছে মহাবিশ্বের। অথচ পৃথিবী যত ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির সাক্ষী হয়েছে, যতবার অগ্নি প্রজ্বালিত হয়েছে ইতিহাসের পাতায়, মহাদেশ-উপমহাদেশে কিংবা বিশ্ব মানচিত্রে তৈরি হয়েছে যত সংকট, তার মূলে বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখলে দেখা যাবে, সেখানে রয়েছে মিথ্যার আভিজাত্য। বিশ্বাসঘাতকতা অথবা নির্দিষ্টভাবে ছক কষা প্রতারণার বিস্তৃত জাল। পৃথিবীর ইতিহাসে যত দুর্যোগ, যত সংকটে আচ্ছন্ন খারাপ প্রভাব; তারই মূলে রয়েছে ভয়ানক মিথ্যার প্রশ্রয়।

‘আমার পথ’ প্রবন্ধে কবি কাজী নজরুল ইসলামের উক্ত আলাপনটি মেনে নেওয়ার অর্থ হলো, আপনি ভীষণ সুন্দরভাবে সত্যকে মেনে নিয়েছেন এবং দারুণভাবে তার বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। চেষ্টার পরিসীমার কাছে না পৌঁছালেও বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী আমরা অত্যন্ত সুনিপুণ দক্ষতার সঙ্গে সত্যকে এড়িয়ে চলে যেতেই বেশি পছন্দ করি। ঘুমন্ত মানুষকে তো সহজেই জাগিয়ে তোলা যায়। ঘুমের অভিনয় করা মানুষকে কি জাগিয়ে তোলা যায়? আমরা বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হতে হতে নিজস্ব সত্তা-সংস্কৃতির ওপর এতটাই বাজে প্রভাব পড়েছে যে আমাদের নিজস্ব বলতে কিছু পচে যাওয়া গল্প ছাড়া তেমন কিছুই নেই। আমরা আরেকজনের মতো হতে চাই। এই অন্যের মতো হতে চাওয়ার প্রবণতা আমাদের প্রায় ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে এসেছে!

আমাদের সত্যচর্চার ক্ষেত্র ঠিক এই মুহূর্তে কোন অবস্থায় কিংবা কোন পরিস্থিতিতে এসে ঠেকেছে, তা বিবেচনার বিষয়। এই বিবেচনায় মানুষকে অবশ্য খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। পত্র-পত্রিকার পাতায় খুশির খবর খোঁজার আপ্রাণ প্রচেষ্টাই তার প্রমাণ। আজকাল সেই খুশির খবর খুব কমই পাওয়া যায়। এ সবকিছু আমরা সহজভাবে মেনে নিয়েছি। মনেও নিয়েছি। এত এত বিবেক-বিবেচনাহীন গল্প মনে রাখার ব্যাপ্তিকাল শুধু একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলার সময়ের সমান। সমাজ, সংস্কৃতিতে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য ঠিক কতটা ভয়াবহতার ছাপ ফেলেছে, তা নিয়ে চিন্তা করতে গেলে গায়ে কাঁটা দেওয়ার কথা! অথচ দিচ্ছে না। সত্য এবং মিথ্যার পার্থক্যের মধ্যে কতটুকু দূরত্ব তৈরি হলে আমাদের বর্তমান সমাজ-সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি আমাদের চিন্তিত করে তোলে না; বরং সে কথা মনে হলে শিউরে উঠি!

মিথ্যের চাকচিক্য সহজেই সবার নজর কেড়ে নেয়। মানুষের চিন্তাচেতনা, বিবেক-বুদ্ধিকে বিকৃত পথে নেওয়ার জন্য ওই চাকচিক্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যায়। একজন মানুষের ভুল পথে হারিয়ে যাওয়া নির্ভর করে সেই ব্যক্তির চিন্তাচেতনার পরিধি কতটা বেশি এবং বিবেক-বুদ্ধি কতটা দৃঢ় ও পরিপক্ব, তার ওপর। সত্য নিভৃতে জ্বলজ্বল করে, ঠিক জোনাকির আলোর মতো। জোনাকির নিবু নিবু আলোয় যেমন অসম্ভব মায়া থাকে, সত্যের মধ্যেও তেমনই নীরব স্নিগ্ধতা বাস করে। সেই মায়াতে এই সংকটের সময়েও কিছু মানুষ নিজেকে মাখামাখি করে নেয়। চাকচিক্যের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলা মানুষগুলো নিতান্তই দুর্ভাগা বলা চলে। একসময় চাকচিক্য শেষ হয়ে যায়! মানুষ তখন দিশাহারা হয়ে পড়ে। মিথ্যা তাদের নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয় গহিন অরণ্যের ঠিক মাঝখানটায়। যেখান থেকে বোঝার উপায় নেই মুক্তির পথ কোনো দিকে। চারদিক অন্ধকার!

তবু সংকটের সমাধান হয়। সমাধান হয় আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে। নিজের ভুল স্বীকার করে নেওয়ার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় গুণাবলিটুকুরও অভাব বাজারে। খাপছাড়া যুক্তি দিয়ে হলেও আমরা জিতে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাই। ভুল স্বীকার করে হেরে যাওয়ার মধ্যে যে ক্ষীণ আনন্দ আছে, তা অনুভব করার শক্তি আমরা হারিয়েছি অনেক আগেই। অনুতপ্তবোধের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করলে মানুষ পথ খুঁজে পেতে পারে। সৃষ্টিকর্তা অনুতপ্তবোধকে পছন্দ করেন। মানুষ যখন ভুল পথে প্রতিনিয়ত অগ্রসর হতে থাকে, সৃষ্টিকর্তা তখনো তাঁর সৃষ্টির সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এই রঙিন পৃথিবীতে মানুষের ভুল করে ফেলাটা স্বাভাবিক। তবে সেই ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সঠিক পথে ফিরে আসা অত্যন্ত জরুরি। একইভাবে ভুল পথে আর দ্বিতীয়বার না যাওয়ার মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে নেওয়ার মধ্যেই প্রকৃত সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে।

সত্যচর্চার মাধ্যমে এক জীবনে পৃথিবী কতটা সহজ হতে পারে, তা একমাত্র সত্যবাদী মানুষেরাই বলতে পারেন। সত্যের অনুশীলন হোক প্রতিটি নতুন সকালের প্রত্যয়। সত্যের আভিজাত্য এবং সৌন্দর্য আমাদের সবার জীবনে জোনাকির আলোর মতোই জ্বলতে থাকুক। সত্য সুন্দর, সত্য সমৃদ্ধ, সত্য আভিজাত্য, সত্য প্রেম, সত্যই প্রণয়। সত্যের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ুক প্রতিটি জীবনে।

শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়