জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছা করে, ‘মা তোমাকে ভালোবাসি’
তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। আমার দুই খালাম্মা আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসে দেখলেন আমি পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে দুষ্টুমি, মারামারিতে লিপ্ত থেকে পড়াশোনা করছি না! তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে যাবেন। অতঃপর নানাবাড়িতে নিয়ে আমাকে সেখানকার প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। সেখানে গিয়ে পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ বাড়তে থাকলেও মায়ের সঙ্গে আমার দিন দিন দূরত্ব বাড়তে থাকে।
প্রথম দিকে ঘন ঘন বাড়িতে গেলেও একটা সময় তা কমে যায়। নানাবাড়িতে মন বসে যাওয়ার পর খুব একটা বাড়িতে যেতে চাইতাম না। এখনকার মতো তখন যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত ছিল না, মুঠোফোনের প্রচলনও ছিল না। দীর্ঘ মেয়াদে স্কুল বন্ধ হলে কিংবা কোনো প্রয়োজন পড়লে বাড়িতে যেতাম পায়ে হেঁটে! নানাবাড়ি আর আমাদের বাড়ি ৪০ বা ৪৫ মিনিটের দূরত্ব। মায়ের কাছ থেকে প্রতিবার বিদায় নেওয়ার সময় তিনি উঠোন পেরিয়ে আসতেন আমার পিছু পিছু। আমাকে যত দূর দেখা যায় তাকিয়ে থাকতেন। আমিও বারবার পেছন ফিরে তাকাতাম মাকে একনজর দেখার জন্য!
মাকে নিয়মিত চিঠি লিখতাম। সে চিঠি আমার কলেজপড়ুয়া খালাম্মা আমাদের এলাকা থেকে কলেজে আসা তাঁদের এক বান্ধবীর মাধ্যমে মায়ের কাছে পৌঁছে দিতেন। মা–ও একইভাবে ফিরতি চিঠি দিতেন। চিঠি কখনো তিনি লিখতেন, কখনো আপাকে দিয়ে লেখাতেন। ছোট্ট সেই চিঠিখানায় হাত বোলালে মায়ের ছোঁয়া পেতাম। মা আমার জন্য চিঠির খামের ভেতরে ১০ বা ২০ টাকা পাঠাতেন! টাকা পেয়ে সে কি খুশি হতাম! প্রাইমারিতে পড়ার সময় (১৯৮৯-১৯৯১ সালে) এ টাকার অনেক মূল্য ছিল!
এভাবে প্রাইমারি, হাইস্কুল, ইন্টারমিডিয়েট শেষ করলাম নানাবাড়িতে থেকে। অনার্সে ভর্তি হয়ে শহরে চলে আসি। ফয়েজ মামার সঙ্গে ব্যাচেলর বাসায় থাকি কিছুদিন। পরে ছোটখালার বাসায় চলে যাই দুজন। শহর থেকে বেড়াতে গেলে নানাবাড়িতেই যেতাম, সেখানে বন্ধুবান্ধব ছিল, নানা ছিল। মায়ের কাছে খুব কমই যাওয়া হতো। দিন যায়, মায়ের সঙ্গে আমার অদৃশ্য দূরত্ব বাড়তে থাকে!
অনার্সের পর মাস্টার্সে পড়ার সময় সরকারি চাকরিতে যুক্ত হই। এর কিছুদিন পরই পারিবারিকভাবে মেয়ে পছন্দ করে বিয়ের জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়! সেদিন বুকে অনেক ব্যথা জমানো থাকলেও মাকে না বলতে পারিনি। মাকে তখন না বলে পরবর্তী সময়ে নিজের পছন্দের কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারতাম। কিন্তু মায়ের সঙ্গে বনিবনা না হলে মা কষ্ট পাবেন ভেবে তাঁদের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হই। অবশ্য দাম্পত্যজীবনে সুখে আছি।
মাকে প্রাণখুলে ‘মা’ বলে ডাকতে পারি না বহুকাল ধরে। অজানা এক সংকোচবোধ কাজ করে! মা আমার ছোট ভাইটিকে যেভাবে শাসন-সোহাগ করেন, আমাকে তেমন করতে পারেন না। অনেক চেষ্টা করেও ওনার সঙ্গে ফ্রি হতে পারি না। বাবাকে হারিয়েছি বছর দুয়েক হলো। তাঁর সঙ্গেও ফ্রি ছিলাম না। এখন মা আমার একমাত্র অভিভাবক।
আমার প্রতি মায়ের অনেক ক্ষোভ জমে থাকতে পারে। শবে বরাত, শবে কদর–এর রাতে ইচ্ছা করে ওনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না! মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছা করে, ‘মা তোমাকে ভালোবাসি। আমাকে ক্ষমা করে দিও! কিন্তু বলা হয় না!’
মায়ের খুব ইচ্ছা কাবা শরিফ জিয়ারত করবেন। হজ করানোর সামর্থ্য আমার এখনো হয়নি। তবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওনাকে নিয়ে ওমরাহ করব। সে লক্ষ্যে পাসপোর্ট বানাতে দিয়েছি। আল্লাহর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের পা ধরে ক্ষমা চাইব আর বলব, তাঁকে খুব ভালোবাসি।
হাইলধর, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম