সহেলিকে ফুল নিয়ে আসতে বলেছিলাম। দীঘার সমুদ্রসৈকতে বালুচরে সূর্যাস্তের সময় আমরা একটি বালুর ঘর বানাব। বালু দিয়ে ঘর তৈরি করে ফুল দিয়ে সাজিয়ে দেব। ঘরটা ক্ষণিকের হবে, ক্ষতি নেই। ঢেউ এসে একসময় ভেঙে দিয়ে চলে যাবে। জলের স্রোতে, জলের তলায় মিলিয়ে যাবে জীবনের খেলাঘর। ভাঙে বলেই তো পৃথিবীতে প্রতিটি জিনিস গড়ে। জীবনের এক কূল ভাঙে, অন্য কূল ভেসে ওঠে। ভাঙা-গড়া, বাঁচা-মরা নিয়েই তো জীবন। মাঝখানে শৈল্পিক রূপ দেওয়া ঘর বানিয়ে মুহূর্তকে সাক্ষী করে দুজনে পাশাপাশি বসে থাকব। ভবিষ্যতে এমন ঘর বানানোর গোধূলি লগনের স্বপ্ন সাক্ষী থাকবে এই অমূল্য স্মৃতি। গোটা জীবন একটা স্মৃতিরও মস্ত বহর।
সহেলি কলকাতা থেকে এসে পৌঁছেছে দুপুর বারোটায়। ফুল নিয়ে আসতে ভুলে গেছে। ভোরে বাসে ওঠার আগে ফুলের দোকানে যাওয়ার কথা মনে ছিল না। তবে বাসে উঠেই মনে পড়াতে হোয়াটসঅ্যাপে লিখেছে, সঙ্গে কবিতা লেখার ডায়েরি আছে। সে তো কাগজের ফুল বানাতে পারে। ডায়েরির পাতা তুলে সমুদ্র, আকাশ, বাতাসকে সাক্ষী করে মনের ফুল বানিয়ে দেবে। আর সাজিয়ে তুলবে বালুঘর। আমি উত্তরে লিখেছি, ‘তুমি আসলেই হবে। তুমিই তো আমার ফুল।’
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বিকেলের সৈকতে আমরা বালুঘর বানাতে শুরু করলাম। বালুর ভিতের ওপর সুন্দর কারুকার্যের একটি বালুর বাড়ি কাগজের ফুল দিয়ে সেজে উঠল।
গতকাল বিকেলে দীঘায় এসে পৌঁছেছি। সাংবাদিকতার কাজে হলদিয়া হয়ে, ভগবানপুর, কাঁথি—এসব অঞ্চলে তিন দিন ধরে হাসপাতাল, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছি। স্বাস্থ্য দপ্তর, চিকিৎসক হয়ে স্থানীয় প্রশাসন, বিধায়ক, চেয়ারম্যানদের বাড়িতেও যাওয়া হয়েছে। কাঁথি থেকে শনিবার বিকেলে দীঘা চলে আসব সহেলির সঙ্গে পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম। শনিবার কলকাতায় ওর চাকরি সামলে দীঘা আসতে গেলে অনেক রাত হয়ে যাবে। তাই বারণ করেছি।
হোটেলে ব্যাগ রেখে গতকাল সন্ধ্যায় সমুদ্রসৈকতে এসে বসে ছিলাম। চট্টগ্রামের কক্সবাজার আর পতেঙ্গার কথা খুব মনে পড়ছিল। আমার জন্ম চট্টগ্রামে। শহরের বাসায় বেড়ে উঠেছি। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত শহরের স্কুলে পড়াশোনা করেছি। একসময় বুকভরা দুঃখ নিয়ে ১৩ বছর বয়সে দেশ ছেড়ে আসতে হয়েছে।
পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে মা–বাবা, ভাইবোন মিলে একবার গিয়েছিলাম। কক্সবাজার কখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তবে বাবা বছরে দু–একবার বন্ধুদের সঙ্গে কক্সবাজার যেতেন। সেখানে সমুদ্রে স্নান করার, ঘুরে বেড়ানোর ছবি তুলে এনে দেখাতেন। আসার সময় বোনের জন্য পুঁতির মালা, ঝিনুকের পুতুল, ঘর সাজানোর ঝিনুকের সামগ্রী, প্যাকেট ভর্তি কুলের আচার, তেঁতুলের আচার ইত্যাদি কিনে আনতেন। আচারের বড় প্যাকেটের ভেতর অনেকগুলো ছোট ছোট প্যাকেট থাকত। প্রতিদিন এক প্যাকেট করে নিয়ে প্রায় এক-দেড় মাস সবাই আচার খেতাম আর কক্সবাজারকে মনে রাখতাম।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতির কারণে আমার অবস্থান পাল্টেছে। ভারতে এসে পড়াশোনা শেষ করে এখানে সাংবাদিকতা করি। পুরোনো দিনের স্মৃতি তো কেউ ভুলতে পারে না। শৈশবে পড়া বন্দে আলী মিঞার ছড়া, জয়নুল আবেদিন দুর্ভিক্ষের কাকের ছবি আঁকতেন কিংবা ফুটবলার পেলেকে ‘কালো মানিক’ বলা হয়—পাঠ্যবইয়ে পড়া এসবের মতো অন্য সব স্মৃতিও কেউ ভুলতে পারে না।
দীঘার সমুদ্রসৈকতে বসে মনে হচ্ছিল দুই বাংলার কূলবর্তী একটাই তো বঙ্গোপসাগর। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে সন্ধ্যা নেমে আসার মতো দীঘার সন্ধ্যাও একই রকম মনোরম। জলের কোনো বিভাজন হয় না। বঙ্গোপসাগর গোটা একটা অবিভক্ত বঙ্গ দেশের, গোটা একটা বাঙালি জাতির পরিচয় ধারণ করে। পুঁতির মালা, ঝিনুক সামগ্রীর দোকান এখানেও আছে। কক্সবাজারের মতো বড় প্যাকেটের ভেতরে ছোট ছোট প্যাকেটের সেই কুলের, তেঁতুলের আচার শুধু দেখলাম না। সৈকতে ডাব বিক্রি হচ্ছে। বিশাল সমুদ্রের জলরাশির সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষুদ্র ফলের ভেতরের জল খেলাম।
হোটেলে কফি খেতে খেতে সহেলি সিগারেট ধরিয়েছে। বড় বেসরকারি সংস্থায় জনসংযোগ আধিকারিকের কাজ করে সে। কলকাতার পত্রিকায় আমাদের দুজনের পাশাপাশি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল দুই বছর আগে। সেই সূত্রে দুই তরুণ কবির আলাপ। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। দিনে এক প্যাকেট করে সিগারেট ফোঁকে সে। আমি অবশ্য ধূমপান করি না। মদ, বিড়ি, সিগারেট কোনো কিছুর নেশা নেই, কবিতা লেখা ছাড়া। আবার স্বাস্থ্যবিষয়ক কাগজে কাজ করি, ধূমপান নিয়ে ক্ষতিকারক দিকগুলো সহেলিকে বেশ কয়েকবার বলেছি। কিন্তু নিজের প্রেমিকা হলেও কারও ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ কখনো করি না। সহেলি নিজেও আমাকে কখনো সিগারেট খেতে উৎসাহিত করেনি।
সমুদ্রে দুজনে স্নান করে এসে আবার হোটেলের বাথরুমে পরিষ্কার জলে স্নান করে শরীর থেকে বালু ঝেড়ে নিলাম। তিন রকম মাছের পদ দিয়ে সমুদ্রতীরবর্তী স্থানীয় হোটেলে দুপুরের আহার জমে উঠল। পশ্চিমবঙ্গের দীঘা সমুদ্রসৈকত মেদিনীপুরের শেষ প্রান্ত আবার ওডিশা রাজ্যের প্রান্তবর্তী। ফলে এখানকার বাঙালিদের আঞ্চলিক বাংলাটা অন্য রকম টানের। শুনতে বেশ মজা লাগে। সামুদ্রিক মাছের অতুলনীয় স্বাদের অবশ্য কোনো ভাগ হয় না।
পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বিকেলের সৈকতে আমরা বালুঘর বানাতে শুরু করলাম। বালুর ভিতের ওপর সুন্দর কারুকার্যের একটি বালুর বাড়ি কাগজের ফুল দিয়ে সেজে উঠল। বেশির ভাগ কৃতিত্ব সহেলির। কবিতা লেখার মতো শৈল্পিক হাতের কাজেও সে যথেষ্ট দক্ষ। ওদের অত বড় অফিসটাও সুন্দর সেজে উঠেছে ওর শৈল্পিক দক্ষতায়।
নিজেদের গড়া বাড়ির সামনে বসে দুজনে দুজনের কবিতা পড়ে গড়িয়ে যেতে লাগল সন্ধ্যা। মনের ভেতর উথালপাতাল সুন্দর অনুভূতি। ঢেউ একেবারে বাড়ির নাগালে চলে এসেছে। একসময় ভাঙতে শুরু করে আমাদের বাড়ি। জলের ঝাপটা এসে লাগছে শরীরে। বাতাস তখন আরও বেগবান। আমার পিঠে একটা তোয়ালে আছে। এই বড় তোয়ালেটিরও একটা স্মৃতি আছে।
ছোটবেলায় দেশ ছেড়ে আসার সময় এই তোয়ালে সঙ্গে এনেছিলাম। বাবা কক্সবাজার থেকে কোনো এক বছর তোয়ালেটা কিনে এনেছিল। ঘরে কখনো ব্যবহার করা হয়নি। আলমারিতে রাখা ছিল। এপারে এসেও দেশের স্মৃতি হিসেবে যত্ন করে তুলে রেখেছিল মা। এবারের সফরে আসার সময় আমি আলমারি থেকে বের করে ব্যাগে নিয়েছি।
জলের ঝাপটা সহেলির মুখে এসে পড়ছে। আমি তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে দিলাম। সহেলি তোয়ালেটা হাতে নিয়ে এক প্রান্ত ধরেছে। ওড়নার মতো বাতাসে উড়ছে তখন বাংলাদেশের এই নিশান। বাঙাল এই কবিকে সম্পূর্ণ এপারের শ্রীরামপুরের এই মেয়ে ভালোবেসেছে। খেলাঘর ভেঙে গেলেও দুই কবিতে মিলে কবিতার ঘর বাঁধতে আমরা প্রস্তুত। একসময় হঠাৎ সহেলির হাত ছেড়ে নিশানটা উড়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে দূরে জলের তোড়ে ভেসে যেতে লাগল।
ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেও পারলাম না। বহু বছরের পুরোনো স্মৃতি হারিয়ে যাওয়াতে একটু কষ্ট হলো। কিন্তু কক্সবাজারে কেনা তোয়ালে দীঘাতে এসে ভেসে যাচ্ছে, বিষয়টা কেমন যেন অদ্ভুত মনে হতে লাগল। সহেলিও এই তোয়ালের ইতিহাস জানে। ওরও খারাপ লাগছে বেশ।
আমি ওর হাত শক্ত করে ধরে বললাম, ‘দেখো, কক্সবাজারের তোয়ালে ভাসতে ভাসতে হয়তো আবার কক্সবাজার ফিরে যাবে। আমরাও দুজনে একবার কক্সবাজার বেড়াতে যাব।’ বিষণ্ন মুখে ফুটে উঠল হাসি। দীঘার সমুদ্রের লোনাপানি আমাদের ঘনত্ব বাড়িয়ে তুলছে।
সহেলি বলল, ‘আমি তোমার প্রিয় কুলের আচার কুড়ি প্যাকেট প্লেনে নিয়ে আসব।’
আমি হেসে বললাম, ‘ঠিক আছে, কক্সবাজারে সৈকতে দাঁড়িয়ে তোমার গলায় পুঁতির মালা পরিয়ে দেব।’