আমাদের বিতর্কচর্চা

বিতর্ক উৎসবছবি: জুয়েল শীল, চট্টগ্রাম

বিতর্ক কেন করি? এর জবাবে প্রায় সব বিতার্কিককে বলতে শুনেছি—সত্যকে যুক্তি দিয়ে বিচার করতে চাই; কুসংস্কার ও অজ্ঞতার ঊর্ধ্বে প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে বিতর্ক করি; সত্য প্রতিষ্ঠায় বিতর্ক করি। তবে এগুলোর পাশাপাশি সবচেয়ে সহজ কথায় বোধ হয় বলা যায়, নিজেকে যুক্তিবোধের মাধ্যমে পরিশীলিত করে এবং অন্যের মতকে প্রাধান্য দিতে শেখার প্রক্রিয়াটিই বিতর্ক।

এ ব্যাপারে বিশ শতকের পাশ্চাত্যের দার্শনিক কার্ল রেইমান্ড পপ্পারের একটি কথা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘I May Be Wrong And You May Be Right And, By An Effort, We May Get Nearer The Truth.’

বিতর্ক হলো বিশেষভাবে তর্ক। বলা হয়, Debate Is a Art of Improvisation, বিতর্ক উদ্বুদ্ধকরণের শাস্ত্র। বিতর্ক যুক্তিবোধের শাস্ত্র। অতি সাধারণ কথায় নির্দিষ্ট একটি বিষয়ে দলীয় অবস্থান থেকে তত্ত্ব উদাহরণ ও তথ্য দিয়ে যুক্তিপূর্ণভাবে নিজের বক্তব্য উপস্থাপনাই হলো বিতর্ক। প্রাচীনকালে গ্রিসের এই চর্চাটি উপমহাদেশ হয়ে বাংলাদেশে আসে। গ্রিক সভ্যতার বিকাশে বিতর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অনেকে গ্রিসের দার্শনিক ডেমসথেনেসকে বিতর্কশাস্ত্রের জনক বলেন। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস উদ্বুদ্ধকরণের এই শিল্পেই যুবসমাজকে নৈতিকতা ও আত্মবোধে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। বিতর্ক বৃহৎ পরিসরে মুক্ত সমাজ ও গণতন্ত্র বিকাশের প্রয়োজনীয় উপাদানের সন্নিবেশ ঘটায়।

বর্তমানে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বিতর্কের ধারা প্রচলিত। এগুলো হলো:

সনাতনী

বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও টেলিভিশনে যে বিতর্কধারা চালু হয়েছে, তা-ই সনাতনী ধারা। এটি সবচেয়ে পুরোনো ধারার বিতর্ক। দুটি দলে সদস্যসংখ্যা থাকেন তিনজন করে। একটিকে বলা হয় পক্ষ দল এবং অন্যটিকে বলা হয় বিপক্ষ দল। যিনি বিতর্ক পরিচালনা করেন, তাঁকে বলা হয় সভাপতি বা মডারেটর। একটি বিষয় থাকে। বিষয়ের পক্ষ-বিপক্ষ টসে নির্ধারিত হয়। পক্ষ দল বিষয়ের পক্ষে নিজস্ব যুক্তি, তথ্য বিশ্লেষণ তুলে কথা বলে, অন্যদিকে বিপক্ষ দল বিষয়ের পক্ষে নিজস্ব যুক্তি, তথ্য বিশ্লেষণ তুলে কথা বলে সেটির বিরোধিতা করে। সনাতনী বিতর্কে দুটি পর্ব থাকে। প্রথমে গঠনমূলক পর্ব, এরপর যুক্তিখণ্ডন পর্ব।
গঠনমূলক পর্বে প্রত্যেক বক্তা নিজের বক্তব্য প্রদানের জন্য পাঁচ মিনিট করে সময় পাবেন। নিচের পর্যায়ক্রমে বিতর্ক এগিয়ে যায়—

পক্ষ দল
প্রথম বক্তা
দ্বিতীয় বক্তা
দলনেতা

বিপক্ষ দল
প্রথম বক্তা
দ্বিতীয় বক্তা
দলনেতা

দায়িত্ব: উভয় দলের প্রথম বক্তার কাজ হলো বিষয়টি এবং দলের অবস্থান পরিষ্কার করে বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দলীয় কৌশল তুলে ধরা। পুরো বিতর্কটি কেমন হবে, সেটার রূপরেখা প্রদান করা। বিপক্ষ দলের প্রথম বক্তার আরেকটি কাজ হচ্ছে, তাঁর আগের বক্তার বক্তব্য অর্থাৎ পক্ষ দলের প্রথম বক্তার বক্তব্যের যুক্তি খণ্ডন এবং পক্ষ দলের সীমাবদ্ধতা আলোচনা করা। তবে সনাতনী বিতর্কে অন্যতম সমস্যা হলো পক্ষ দলের প্রথম বক্তার যুক্তি খণ্ডনের সুযোগ নেই। তবে তিনি যুক্তি প্রদান করতে পারেন।

দুই দলের দ্বিতীয় বক্তা নিজেদের অবস্থান শক্ত করার জন্য অপর পক্ষের যুক্তি খণ্ডন, যুক্তি প্রদান, উদাহরণ, তত্ত্ব ও তথ্যের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের অবস্থানের অসারতা প্রমাণের চেষ্টা করবেন।

দলনেতারা নিজেদের দলীয় অবস্থান নিয়ে কথা বলবেন। তবে তাঁরা উভয়ই দলীয় একটি সারমর্ম প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করবেন।
বিতর্কের সময় আয়োজক কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে। তবে মূল পর্বের জন্য প্রত্যেক বক্তা পাঁচ মিনিট করে (এক মিনিট আগে সতর্কসংকেত) ও যুক্তিখণ্ডন পর্বে দলনেতারা দুই মিনিট করে সময় পাবেন (দেড় মিনিটে সতর্কসংকেত)।

সনাতনী বিতর্কে সাধারণত সংজ্ঞা, উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি, তথ্য, তত্ত্ব ও উদাহরণ, যুক্তি প্রয়োগ ও খণ্ডন প্রভৃতি বিষয়ে নম্বর দেওয়া হয়। এই বিষয়গুলোর ওপর ভিত্তি করে ৩০, ৪০ বা ৫০ নম্বর বণ্টন করা হয়। আয়োজকেরা নম্বর কমবেশি করতে পারেন।

বারোয়ারি বিতর্ক

বিতর্কের সবচেয়ে শিল্পিত ধারার নাম বারোয়ারি বিতর্ক। বিতর্কের এই ফরম্যাটটি অন্যগুলোর চেয়ে একটু আলাদা। এ বিতর্ক দলগতভাবে নয়, হয় ব্যক্তিগতভাবে। যেখানে একটি বিষয়ের ওপর বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে বিতর্ক করেন। এই বিতর্ক আমরা public speaking কিংবা উপস্থিত বক্তৃতার সঙ্গে তুলনা করতে পারি। এই বিতর্কের বিষয় হয় অনেকটা মুক্ত ধরনের। ভাবনার অভিনবত্ব ও সৃষ্টিশীলতা এ বিতর্কের প্রাণ। ধরুন, বিতর্কের বিষয় হলো, ‘আমার যদি একটি জাদুর পেনসিল থাকত...।’ এই....জায়গাটি নিজের মনের মতো করে পূরণ করে, নেই বিষয়টি প্রমাণ করতে হয়। সুন্দর ও সৃজনশীল একটি স্ট্যান্ড পয়েন্ট দাঁড় করাতে হবে। স্ট্যান্ড পয়েন্টটি দাঁড় করানোর পর বিষয়ের সঙ্গে একটি সুন্দর সম্পর্ক দাঁড় করাতে হবে। এরপরেই বিভিন্ন যুক্তি ও কৌশল অবলম্বন করে বিষয়টিকে প্রদত্ত স্ট্যান্ড পয়েন্টের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হয়। কোনো অবস্থাতেই একাধিক স্ট্যান্ড পয়েন্ট নেওয়া ঠিক নয়। তবে বিষয়...ছাড়াও থাকতে পারে।

এ বিতর্কে আবেগ ও শব্দচয়নের মধ্যে সুন্দর সামঞ্জস্য তৈরি করতে হয়। একটি বিষয়ের ওপর ১০ থেকে ১৫ জন নিজেদের মতামত ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে প্রকাশ করেন। মোদ্দাকথা, বারোয়ারিতে বিতার্কিক মন খুলে ভাবনার জায়গা এবং সেটিকে যুক্তি ও শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশের সুযোগ পান।

বারোয়ারি বিতর্কের বিষয়গুলো এমন হতে পারে

আমি যদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতাম...; তোরা যে যা বলিস ভাই.... আমারও ইচ্ছা করে...:

সংসদীয় বিতর্ক

সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় মডেল সংসদীয় বিতর্ক। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্সের অনুসরণে এ বিতর্কের ধারাটি বাংলাদেশে চালু হয়েছে। দুটি দলে তিনজন করে মোট ছয়জন বিতার্কিক ‘ছায়া সংসদে’ অংশ নেন । সংসদীয় বিতর্কে পক্ষ দল সরকারি এবং বিপক্ষ বিরোধী দল হিসেবে গণ্য হয়। সরকারি দলের তিনজন প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সাংসদ এবং বিরোধী দলের তিনজন বিরোধীদলীয় নেতা, উপনেতা ও সাংসদ হিসেবে অংশ নেন। মডারেটরকে স্পিকার হিসেবে সম্বোধন করতে হয়। এই ধারাটি খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয় হওয়ার প্রধান কারণ এ বিতর্কের পয়েন্টগুলো। সংসদীয় বিতর্কে তিন ধরনের পয়েন্ট উত্থাপিত হয়—

১. পয়েন্ট অব অর্ডার; Point Of Order (POI),
২. পয়েন্ট অব প্রিভিলেজ অথবা পয়েন্ট অব পারসোনাল প্রিভিলেজ; Point Of Privilege or Point Of Personal Privilege (POP or POPP),
৩. পয়েন্ট অব ইনফরমেশন; Point of Information (POI).

সংসদীয় বিতর্কে প্রত্যেক বক্তা পাঁচ মিনিট করে বক্তব্যের সুযোগ পান। উভয় দলের দলনেতা যুক্তিখণ্ডনে তিন মিনিট করে সময় পান।

গঠনমূলক পর্বের দ্বিতীয় মিনিটের পর থেকে চার মিনিটের শেষ পর্যন্ত ‘POI’ ও ‘POP/POO’ উত্থাপন করা যাবে। যুক্তিখণ্ডন পর্বের প্রথম মিনিটে কোনো পয়েন্ট ওঠানো যাবে না, শেষ দুই মিনিটে ‘POP/POO’ উত্থাপন করা যাবে। একজন বক্তাকে নিম্নে দুটি ‘POI’ গ্রহণ করতেই হয়। অন্যথায় নেতিবাচক নম্বর প্রদান করা হয়। একজন বক্তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ তিনটি ‘POP/POO’ উত্থাপন করা ভালো। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরে বিরোধীদলীয় নেতা তাঁর দলীয় অবস্থান গুছিয়ে নেওয়ার জন্য এক মিনিট সময় পান।

বিতর্কে প্রধানমন্ত্রীর সংজ্ঞা যদি মেনে নেওয়া হয়, তবে তা পুরো বিতর্কে পরিবর্তন করা যাবে না। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত বিতর্কের প্রপঞ্চ কিংবা সূচক (parameter) সংজ্ঞায়নের অন্তর্ভুক্ত হবে না। বিরোধী দল এর বাইরে গিয়ে নতুন সূচক আনতে পারবে, তবে তাকে প্রমাণ করতে হবে যে ওই সূচকটি বিতর্কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

যদি প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা তাঁর দলের নির্ধারিত কৌশলের সে ক্ষেত্রে মন্ত্রী কিংবা উপনেতা নতুন যুক্তির অবতারণা করতে পারবেন, তবে তা কোনোভাবেই সাংঘর্ষিক হতে পারবে না এবং বিতর্ককে নতুন দিকে প্রবাহিত করতে পারবেন না। সাংসদ কোনো নতুন যুক্তির অবতারণা করতে পারবেন না। যুক্তিখণ্ডন পর্বে কোনো নতুন যুক্তির অবতারণা করা যাবে না।

বিরোধীদলীয় নেতা তাঁর বক্তব্যের সময়ে যদি এমন বিষয়ের অবতারণা করেন, যা সংসদীয় রীতিবিরোধী (চ্যালেঞ্জ না করে সংজ্ঞায়নের পরিবর্তন, সরকারি দলের অবস্থানকে নিজের অবস্থান হিসেবে আখ্যা দেওয়া, সরকারি দলের অবস্থানের ভুল ব্যাখ্যা ইত্যাদি, যা বিতর্ককে ঘুরিয়ে দিতে পারে)-তবে তা সঙ্গে সঙ্গে ‘POP/POI’, এর মাধ্যমে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে। অন্যথায় পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে কোনো ‘POP/POI’ উত্থাপন করা যাবে না। কোনো বক্তার বক্তব্য অন্য দল ঠিকভাবে না বলে অর্থাৎ Mis Quote করলে ফ্লোর স্পিকারের বিরুদ্ধে POP or POPP তোলা যাবে।

ট্রুয়িজম ও টটোলজি ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে সংজ্ঞা চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। সংজ্ঞা চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে অবশ্যই ট্রুয়িজম ও টটোলজি উল্লেখ করতে হবে।

সংসদীয় বিতর্কে সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা, তথ্য, তত্ত্ব, উদাহরণ এবং পয়েন্ট মোকাবিলা এবং যুক্তি ও খণ্ডন প্রভৃতি বিষয়ে নম্বর দেওয়া হয়।

জাতিসংঘ মডেল

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমস্যা-সম্ভাবনা এবং সমস্যার সমাধানকল্পে উদ্ভূত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় এ বিতর্কে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যেমন প্রতিটি দেশের একেকজন প্রতিনিধি থাকেন, ঠিক তেমনি একটি দেশের প্রতিনিধি হিসেবে বিতার্কিকেরা দেশটির পররাষ্ট্রনীতির আলোকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমস্যা এবং এর সমাধানে করণীয় বিষয় তুলে ধরেন। একজন সভাপতি বিতর্কটি মডারেট করেন, তাঁকে মডারেটর বলা হয়।

টি-ফরম্যাট

এটি সংসদীয় বিতর্কের মতোই। তবে চারটি দলে দুজন করে বিতার্কিক এখানে অংশ নেন। দলগুলো সরকারি দল-১, সরকারি দল-২, বিরোধী দল-১ এবং বিরোধী দল-২ হিসেবে থাকেন। সংসদীয় বিতর্কের সব নিয়ম এখানে প্রযোজ্য। তবে সরকারি দল-২ সরকারি দল-১ এর সংজ্ঞা ও বিশ্লেষণ দলীয় অবস্থান থেকে নতুনভাবে করতে পারবেন। বিরোধী দলের ব্যাপারেও এমন সুযোগ থাকছে।

প্লানচেট

রোমাঞ্চকর বিতর্কের এই রূপটি সাধারণত Show Debate-এর জন্য, প্রতিযোগিতার জন্য নয়। এই বিতর্ক করতে পরিবেশটি লাগে আলো- আঁধারের মতো। মোম কিংবা মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে মঞ্চটি সাজানো হয়।

আলো-আঁধারের মধ্যে মঞ্চে অথবা মঞ্চের পেছনে বিতার্কিকেরা থাকেন। অতীত ও বর্তমানের আলোচিত- সমালোচিত কিছু চরিত্র নিয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। একে একে বিভিন্ন চরিত্র এসে তাদের কৃতকর্মের বর্ণনা দিয়ে কেন সে-ই শ্রেষ্ঠ, তা প্রমাণের চেষ্টা করেন। বিতর্ক শেষে উপস্থিত দর্শক তার্কিককে তাঁর চরিত্র বা কৃতকর্ম সংশ্লিষ্ট প্রশ্ন করতে পারবেন। মৃত বা জীবিত দুই ধরনের চরিত্রই বিতর্কে উপস্থিত হয়। এই বিতর্কে মজার কাজটি করে থাকেন মডারেটর। যিনি পর্দার আড়াল থেকে বিতর্কটি পরিচালনা করে উপভোগ্য করে তোলেন। মডারেটরকে ‘ওঝা’ বলা হয়।

এ বিতর্কে বিষয়টি এমন হতে পারে, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে আমার অবদানই শ্রেষ্ঠ’। হিটলার, মুসোলিনি, ইয়াসির আরাফাত, শেখ মুজিবুর রহমান, বারাক ওবামা, ভ্লাদিমির পুতিন, সাদ্দাম হোসেন, নেলসন ম্যান্ডেলা, মহাত্মা গান্ধীর প্রতিনিধিরা নিজেদের কৃতকর্ম নিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলবেন।

রম্য

বিতর্ক প্রতিযোগিতায় দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য রম্য বিতর্কের আয়োজন করা হয়। এটি সনাতনী ও সংসদীয় দুভাবেই হতে পারে। এই সংসদ মনে করে যে ‘প্রেমকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হোক’ কিংবা ‘সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানিব্যাগই মূল’ এমন ধরনের বিষয়ে বিতর্ক হতে পারে। বিতার্কিকেরাও এই বিতর্কে বুদ্ধিদীপ্ত ও হাস্যরসাত্মকভাবে বক্তব্য তুলে ধরেন, তবে কোনোক্রমেই সেটা ‘ভাঁড়’ বা ‘জোকারের’ পর্যায়ে যেন হয়ে না যায়, সেদিকে লক্ষ রেখে শালীন শব্দ ব্যবহার করতে হবে।

আঞ্চলিক

আঞ্চলিক বিতর্ককে অনেকে রম্যের একটি ধারা মনে করেন। বারোয়ারি বিতর্কের মতো এখানে দলগতভাবে নয়, বিতর্ক হয় ব্যক্তিগতভাবে। প্রত্যেক বিতার্কিক নির্দিষ্ট অঞ্চলের স্থানীয় ভাষায় বিতর্ক করেন। ‘দেশের মধ্যে আমার এলাকাই সেরা’, এমন বিষয়ে বিতর্ক হতে পারে। এ বিতর্কে বিতার্কিকসংখ্যা যেকোনো সংখ্যার হতে পারে এবং সময় আয়োজকেরা নির্ধারণ করেন। তাঁরা নিজ নিজ এলাকার আলোকে যুক্তি, তথ্য ও উদাহরণ দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা করবেন।

জুটি বিতর্ক

এই বিতর্কটিও শো-ডিবেট হিসেবে জনপ্রিয়। সিনেমা, নাটক, কিংবা বাংলা উপন্যাসে জনপ্রিয় কোনো জুটির ভূমিকায় দুজন করে তার্কিক এতে অংশ নেন। অমিত-লাবণ্য, দেবদাস-পার্বতী, বাকের ভাই-মোনা, অনিমেষ- মাধবীলতা, হিমু-রুপা ইত্যাদি চরিত্রে জুটি বিতর্ক হয়।

জুটি বিতর্কের মতোই সৃষ্টি-স্রষ্টা বিতর্ক। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে অমিত ও লাবণ্যর যেকোনো একজন এবং হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে হিমু ও রুপার একজনের চরিত্র নিয়ে সৃষ্টি-স্রষ্টা বিতর্ক হতে পারে। কে কার কারণে (সৃষ্টি স্রষ্টার কারণে নাকি স্রষ্টা সৃষ্টির কারণে) সেরা হয়েছেন বিতর্কে তাঁরা নিজেদের তা-ই প্রমাণ করার চেষ্টা করেন।

ইংরেজি বিতর্ক

উপরিউক্ত বিতর্কের ধারাগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক বিতর্ক ছাড়া বাকি সব কটিই ইংরেজি বিতর্ক করা যেতে পারে। দেশে নিম্নোক্ত তিন ধরনের বিতর্ক হয়—

*Traditional Formate — সনাতনী ধারার বিতর্কের সব নিয়মনীতি মেনে Traditional Formate-এ বিতর্ক হয়।

*Parliamentary Formate ইংরেজি মাধ্যমে Parliamentary Formate কেই বাংলায় সংসদীয় বিতর্ক বলা হয়ে থাকে। ভিন্ন ভাষায় বাংলা সনাতনী নিয়মে এই বিতর্ক করতে হয়।

*World's Formate International Debate Compitition যে ফরম্যাটে বিতর্ক হয়, তাকে World's Formate বলে। একই সঙ্গে একই বিষয়ে চারটি দল অংশ নেয়। প্রতি দলে দুজন করে তার্কিক থাকেন। তাঁরা এড়া-১, এড়া-২, Opp-1, Opp-২ নামে পরিচিত হয়। আলোচিত এসব ধরন ছাড়াও আরও বিতর্ক হতে পারে। তবে প্রতিযোগিতামূলক বিতর্কে সনাতনী, বারোয়ারি ও সংসদীয় ধারায় হয়। অন্য ফরম্যাটগুলো নতুনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিতার্কিক তৈরির জন্য বা এই শিল্পটির সঙ্গে পরিচিত করার জন্য আয়োজন করা হয়। তবে বিতার্কিকদের অ্যারিস্টোটলের ‘Begging is The Important Part Of a Work’ বাক্যটি মনে রাখতে হবে। অর্থাৎ শুরু করলেই হবে। এই শিল্পের নিয়মিত চর্চাই পারে পরবর্তী প্রজন্মকে আগামীর বাংলাদেশ উপহার দিতে। ‘জোরের যুক্তি নয়, যুক্তির জোর’ দিয়ে স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে তার্কিকেরা ভূমিকা রাখবেন, সেই আশা আমরা করতেই পারি।

সাবেক সভাপতি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি

লেখাটি ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের পঞ্চম সংখ্যা থেকে নেওয়া।