হুমায়ূনের জলতরঙ্গ, শাওনের ‘চন্দ্রকথা’

‘চন্দ্রকথা’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে মেহের আফরোজ শাওন ও আহমেদ রুবেলছবি: সংগৃহীত
মেয়ের রূপ অবিকল মায়ের মতো হবে, তারও যেমন কোনো মানে নেই; আবার একই চেহারার সামান্য এদিক–ওদিক মানুষও পৃথিবীতে অমিল নয়।

জলতরঙ্গের বৈচিত্র্যময় সুমধুর শব্দের মতো সুন্দর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন বাংলা ভাষার কথাসাহিত্যের জাদুকর এবং শৈল্পিক চলমান চিত্রের নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ। চলচ্চিত্রের নাম চন্দ্রকথা। নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন স্বয়ং পরিচালকের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন। নিজের রচনা অবলম্বনে এই চলচ্চিত্রে সুন্দর–অসুন্দরের চিরাচরিত দ্বন্দ্বটিও পরিচালক মেলে ধরেছেন।

গ্রামের জমিদার সরকার বাবু আগের মতো জমিদারি না থাকলেও সেই প্রতাপ কিন্তু এখনো আছে। তিনি সুন্দরের পূজারি। শিল্পরসিকও বলা যায়। তিনিই মূলত একলা ঘরে চিনামাটির বাটি সাজিয়ে জলতরঙ্গ বাজান। এই জলতরঙ্গ বাজানোর মতোই শৈল্পিক দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে পরিপূর্ণ অনবদ্য এই চলচ্চিত্র। বিশেষত মাসুম রহমানের শিল্পনির্দেশনা এবং মাহফুজুর রহমান খানের চিত্রগ্রহণের প্রশংসা করতেই হয়। জমিদার সরকার বাবুর চরিত্রের গাম্ভীর্য, শিল্পরসিক মন, আবার চিরকালীন সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব এবং জটিল কুটিল মানসিক চরিত্র—সবই যথার্থ ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন কিংবদন্তি অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। শুধু আসাদুজ্জামান নূর নামটির জন্য নয়, নিজের লেখা চরিত্রের জন্য উপযুক্ত অভিনেতা নির্বাচনেও পরিচালক যে কতটা চিন্তাভাবনা করতেন, তার প্রমাণ সরকার জমিদার চরিত্রটি। নূরের মতো অভিনেতাকে ব্যবহারের জন্য প্রত্যেক পরিচালকেরই এ রকম গভীর চিন্তাভাবনা থাকা দরকার।

সরকার জমিদার নিজের চারপাশে অসুন্দর কিছু দেখতে পারতেন না। কাক কালো বলে তার চোখে অসুন্দর। কাক সারাক্ষণ কানের কাছে কা কা করে বলে বন্দুক দিয়ে তিনি রোজ দুটো করে কাক মারতেন। কালো বোরকা পরে তার বৃদ্ধ বয়সের তরুণী স্ত্রী চন্দ্র নিষেধ অমান্য করে একদিন বাড়ির বাইরে যাচ্ছিলেন। তিনি বন্দুক তাক করে মেরে ফেলতে চেয়েছেন। এখানে পরিচালক কালো কাকের সঙ্গে কালো বোরকাকেও এক জায়গায় নিয়ে এলেন এবং বোঝানোর চেষ্টা করলেন জয়নুল আবেদীন যে কাকের ছবি এঁকে গেছেন, সেই ছবিটাও একটা শিল্প। কাক অন্য দশটা পাখির মতো একটা পাখি। জমিদারের অসুন্দরের ভাবনা একধরনের মানসিক অসুখ। চন্দ্র প্রথমবার নিষেধ অমান্য করাতে বাড়ির কাজের লোককে দিয়ে তিনি চাবুক মারেন। দ্বিতীয়বার নিষেধ অমান্য করাতে আঙুল কেটে দেন। নিজের শয্যাশায়ী পঙ্গু পুত্র তাকে ‘কাক মারা বীর’ বলে ব্যঙ্গ করে। কাজের লোককে দিয়ে তিনি অসুস্থ ছেলের গায়েও থুতু ছেটান। নিজের এককালের আগ্রাসী প্রবণতা এবং বর্তমানে প্রায় সবকিছুতে একধরনের অক্ষমতা, একাকী জীবনে তার মধ্যে প্রবল মানসিক রোগ নিয়ে এসেছে। লেখক-পরিচালকের অসামান্য মনস্তাত্ত্বিক নিরীক্ষণের প্রতিফলন এই চলচ্চিত্র।

আবার কাহিনির বুননেও নিজের ভাবনার সঙ্গে দর্শকের কৌতূহল বা প্রশ্ন জাগিয়ে দিতে পারেন। চন্দ্রকে তিনি বিয়ে করার কারণ হিসেবে একদিন বলেন, একসময় এই জমিদারবাড়িতে মথুরা নামের এক বাইজি ছিলেন। তিনি যখন আসরে নাচতেন, আড়াল থেকে এই সরকার তখন তা দেখতেন। চন্দ্র দেখতে অবিকল সেই বাইজির মতো। বাইজির সমাধি এখনো বাড়ির পেছনে আছে। এখান থেকেই প্রশ্ন জাগে, চন্দ্র কি তবে মথুরা বাইজির মেয়ে? হয়তো পূর্বপুরুষ তাকে ভোগ করার সময় গর্ভে সন্তান চলে এসেছে। জমিদারবাড়ির কলঙ্কমোচনে লোকচক্ষুর আড়ালে গ্রামের দরিদ্র এক পরিবারের কাছে তাকে লালন–পালন করতে দিয়ে আসা হয়েছে। আবার তা না–ও হতে পারে। মেয়ের রূপ অবিকল মায়ের মতো হবে, তারও যেমন কোনো মানে নেই; আবার একই চেহারার সামান্য এদিক–ওদিক মানুষও পৃথিবীতে অমিল নয়।

‘চন্দ্রকথা’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে মেহের আফরোজ শাওন ও আসাদুজ্জামান নূর
ছবি: সংগৃহীত

গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হয়েও চন্দ্র সুন্দর গান গাইতে পারে। শুনে শুনে গান তুলে ফেলতে পারে। সেলাই থেকে শুরু করে ঘরের সব কাজে সে পারদর্শী। জমিদারবাড়িতে দুধ দিয়ে আসতে যেত, সুন্দরী এই কন্যাকে ভালো লেগে যায় জমিদারবাড়ির কাজের লোক আমিনের। আহমেদ রুবেলের অসামান্য অভিনয়, আমিন চরিত্রটির প্রাণ দিয়েছে। আমিনের সঙ্গে চন্দ্রের বিয়ে একপ্রকার ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু বিয়ের দিন খালাতো ভাই জহিরের সঙ্গে চন্দ্র পালিয়ে যায়। চন্দ্রদের বাড়িতে থাকা বেকার, বাউন্ডুলে, পাড়া চড়ানো জহির মনে মনে আসলে চন্দ্রকে ভালোবাসত। জহির চরিত্রে ফেরদৌস নজরকাড়ার মতো অভিনয় করেছেন।

একটা বিষয় কিন্তু লক্ষণীয়, হুমায়ূনের চলচ্চিত্রগুলোতে শিল্পীদের যথেষ্ট স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু অতি অভিনয়ের কোথাও জায়গা নেই। চাষী নজরুল ইসলামের মতো পরিচালকদের চলচ্চিত্রগুলো একটু দীর্ঘ হয়। কারণ, লেখক-পরিচালক দায়সারা গোছের নয়, ধরে ধরে মনের সব চিত্রকল্প ফুটিয়ে তোলেন। এখানেও জলের ওপরে নদীতে ভেসে চন্দ্র এবং জহিরের সংসার পাতার একটা দৃশ্য আছে। এ ধরনের ভাবনাগুলো কাব্যকল্পনাও বলা যায়। ছবির জন্য দৃশ্য পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী লেখক যেমন গীতিকার হয়ে কিছু গানও লিখে ফেলেন। এই চলচ্চিত্রেও চারটি গান তাঁর লেখা। ‘ও আমার উড়াল পঙ্খীরে...’ সুবীর নন্দীর কণ্ঠে গানটার রেশ মনের মধ্যে থেকে যায়। সংগীত পরিচালনা করেছেন মকসুদ জামিল মিন্টু। এন্ড্রু কিশোর, রুনা লায়লা ছাড়া শাওন নিজেও গান করেছেন।

শাওনের কথা মাথায় রেখে হুমায়ূন চন্দ্র চরিত্রটিকে নির্মাণ করেছেন কি না জানি না। শান্ত, মুখচোরা, কখনো কখনো একেবারে নির্বাক চাহনি আবার স্বাধীনতা পেলে অনর্গল বকে যাওয়ার মতো একটা মেয়ে। কিছু কিছু জায়গায় চরিত্র একটু আড়ষ্ট মনে হয়েছে। আমিনের সঙ্গে সে সংসার বাঁধতে পারে না, জহিরের সঙ্গে পারে না। বৃদ্ধ জমিদার পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তাকে একপ্রকার কারাবন্দী করে। নারীর ওপর পুরুষতান্ত্রিক, জমিদার তান্ত্রিক সর্বমুখী অত্যাচারের কাহিনি এখানে ঘনীভূত হয়। আমিন যদি জমিদারকে গুলি করে না মারত, চন্দ্রর মৃত্যু ছিল অবধারিত। চন্দ্র নিষেধ অমান্য করে, দুঃসাহস দেখিয়ে বাড়ির বাইরে যেতে জানে; কিন্তু বৃদ্ধ জমিদার বদমেজাজি স্বামীকে একেবারে অস্বীকার করার মতো নারীও যেন সে নয়। জীবনের জটিল–কুটিল প্রতিটি দিক তুলে আনতে পারার মধ্যেও অসীম সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে। কুসুন্দরকে হারিয়ে সত্যিকারের সৌন্দর্য প্রকাশে ‘চন্দ্রকথা’ আকাশে চাঁদের মতো দীপ্যমান। চন্দ্র এখানে বারবার রক্তাক্ত হয় বলেই অমানিশা কেটে পূর্ণিমা আসে। হুমায়ূন চিরকালের কথাসাহিত্যের চলচ্চিত্র নির্মাণের জাদুকর আর শাওন বহুমুখী প্রতিভায় আজও চাঁদবদনী।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত