পাঙাশ

অলংকরণ : তুলি

‘ছোড ছাওয়ালডার পাঙাশ মাছ পছন্দের, পাঙাশ মাছ অইলে কুনো কতা নাই, পেট ভইরা চাইরডা ভাত খায়।’ রহিমা বিবি মনে মনে বলে আর আপন মনে কাঁথা সেলাই করে। তার স্বামী লোকমান মিয়া গতর খাটে। পেটের দায়ে মানুষের জমিতে কামলা দেয়। গতর না খাটি উপায় আছে? এই পাট ধোয়ার মৌসুমে কামলার দাম মেলা। বাড়তি হিসেবে পাট ধোয়ার পর শিন্না (পাটখড়ি) মালিকেরা কিছু দিয়ে দেয় চুলা জ্বালানোর জন্য।

‘পাট ধোয়ার পর সোয়ামির ছিপছিপে কালা হাত-পাগুলান কেমন যেন মরা মাছের লাহান সাদা সাদা হইয়া যায়।’ এ কথা বলে রহিমা বিবির মনটা কাতর হয়ে ওঠে। আবার নিজের মনকে বোঝায়, ‘সারা দিন পানিত থাকলে তো অমন হইবেই। কী আর করা। রাইতের বেলা ঘুমানোর সময় সরিষার তেল আর হলুদ দিয়া দেই, যাতে ঘাওটাও না হয়।’
পাটখড়িগুলো রহিমা বিবি তীব্র রোদে শুকিয়ে রাখে বৃষ্টিবাদলের দিনের জন্য। ভেজা স্যাঁতসেঁতে দিনে চুলা জ্বালানো বড় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কাইতেন সাতাও লাগলে তখন একমুঠি পাটখড়ি ভীষণ কাজে লাগে। খুব সহজেই চুলায় আগুন জ্বালানো যায়। আজ শনিবার। অনন্তপুরের হাট। আজগর ব্যাপারী বলছে, হাটের মধ্যে কামলার দাম দেবে।
ছোট ছেলের নাম রামিম। মা–খালারা রামু বলেও ডাকে। সাত বছরের ছেলের মুখের কথা শুনে তার দাদি হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। পাকা পাকা কথার জন্য অনেকে আবার বুড়ার বেটা বলেও ডাকে। বাপের সঙ্গে হাটে যাওয়ার জন্য জোঁকের মতো সে লেগে আছে। একদম নাছোড়বান্দা। কোনো বুঝ মানতে চায় না। সাত বছরের ছেলে কি আর বুঝ মানবে? হাটে যাবে তো যাবেই।

রসগোল্লা খাইবে, ঝালবুট খাইবে, বুট–বুন্দিয়া খাইবে, পুত পুত করা নাল জুতাজোড়া নষ্ট হইয়া গেছে, আগের মতো বাঁশির শব্দ হয় না, ছাওয়ালডা নাল জুতেও নিবে বলি কয় দিন থাকি কানের বগলোত ঘ্যানর ঘ্যানর করবের লাগছে। ‘সোয়ামিডেক আল্লায় ধোয্যও দিছে গো। একবারও না কয় না। আদর–সোহাগ করি কয় কিনি দেইম। ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান বন্দ কর এলা।’ নিজেই নিজেকে বলে রহিমা বিবি।
ছেলেটা কোনোমতে শান্ত হয়। এবার হাটে আর পাঙাশ মাছ কেনা হয় না। ছোট মাছ কেনে লোকমান মিয়া। ছোট ছেলেকে বুঝ দেয় ছোট মাছে ভিটামিন বেশি। কে শোনে কার কথা। পাঙাশ মাছ লাগবেই। রামিম কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে যায়। খেলার নেশায় থাকলে আর মনে থাকে না কী দিয়া ভাত খাবে। মনে হলে আবার কাঁদে পাঙাশ মাছের জন্য।

নিজের কাপড় নিজে কিনতে চায় না লোকমান। রামিমের পেছনে শুধু টাকা খরচ করে। বড় ছেলে রাব্বির জন্যও টাকা পাঠায় মাদ্রাসায়। বড় ছেলেকে হাফেজ বানানোর খুব ইচ্ছা লোকমানের। ‘বংশের মধ্যে যাতে করি হামরাগুলো মরি গেইলে হাত দুকেন তুলি দোয়া টোয়া করবের পায়।’ লোকমান বড় গলায় গ্রামের সবাইকে বলে বেড়ায়। ছেলে হাফেজ হবে।

পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে রাব্বি। তা দেখে মন ভরে যায় লোকমানের। বড় হুজুরদের মতো পায়ের পাতা থেকে পাঞ্জাবি তৈরি করে দিয়েছে সে। হাফিজিয়া মাদ্রাসায় বোর্ডিংয়ে থাকে। দুই–তিন মাস পর একবার আসে। রাব্বি বাড়িতে এলে আর মাদ্রাসায় যেতে চায় না। হুজুরেরা নাকি বেত দিয়েও মারধর করে। ‘আল্লার কালাম মাইর খেয়ে হইলেও শিকপি।’ রহিমা বিবির সাচ্চা কথা। বুঝসুঝ দিয়া ছেলেকে আবার মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেয়।
ছেলের বাবা পনেরো দিন, এক মাস পর গিয়ে চাল–টাকা দিয়ে আসে। এই দুই ছেলে নিয়ে তাদের সুখ–দুঃখের সংসার।