এখন আর নানাবাড়ির সেই চিরচেনা গন্ধ নেই; নেই আর আগের সেই আমেজ। নানা-নানিরা ইহকালের পাট চুকিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন পরকালের জগতে। মামা-খালারাও বিয়েশাদি করে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তাঁদের নিজস্ব সংসারজগতে।
আমাদের বাড়ি থেকে নানাবাড়ির দূরত্ব অনেক। তাই বছরে কেবল দুবার দুই ঈদে নানাবাড়ি যেতাম। অবশ্য স্কুলজীবন শুরুর আগে বছরের প্রায় অনেকটা সময় নানাবাড়িতে কাটিয়েছি। পড়ালেখা শুরুর পর, বছরের দুই ঈদই ছিল নানাবাড়ি বেড়াতে যাওয়ার একমাত্র উপলক্ষ। মামা-খালা আর নানা-নানি এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে বসে থাকতেন—হয় আমরা ঈদের দিন, নয়তো পরদিন ঠিক তাঁদের উঠানে পা ফেলব। হতোও তা–ই।
ঈদ মানেই চারদিকে অফুরান খুশির আমেজ। এই আমেজের সঙ্গে যুক্ত হতো নানাবাড়ি যাওয়ার আনন্দ। ঈদগাহ থেকে ফিরে অপেক্ষায় থাকতাম, আব্বা কখন ডেকে বলেন, ‘এই তোমরা তৈরি হও, আমরা এখন তোমাদের নানাবাড়ি যাব।’ যখন এই শব্দগুচ্ছ কানে আসত, ভাইয়েরা হুড়মুড় করে নিজেদের তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম।
মুড়ির টিন বাসে চড়ে রওনা হতাম। খানাখন্দে ভরা রাস্তা। সেই রাস্তায় দুলুনি খেতে খেতে বাস ছুটে চলত আমাদের নিয়ে। দুলুনির তালে তালে, জানালা দিয়ে গাছেদের ছুটে চলা দেখতে দেখতে নানাবাড়ির পথে এগিয়ে চলতাম। একটা সময় বাসের দুলুনি নামক ঝাঁকির অত্যাচারে বমিটমি করে, ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিতাম সিটে। দীর্ঘ জার্নি শেষে বাস পৌঁছাত গন্তব্যে।
ক্লান্ত শরীরে হেলেদুলে বাস থেকে নামতাম। তারপর স্থানীয় যানবাহন ভ্যানগাড়িতে। হাজির হতাম নানাবাড়ির সদর দরজায়। ভেতরে প্রবেশ করতেই মৌমাছির ঝাঁকের মতো মামা-খালারা এসে ঘিরে ধরতেন। বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে কোলে তুলে নিতেন। ওদিকে আমাদের দেখে তনুমন অস্থির করে, দিনমান বেড়ার ফাঁকে কিংবা ধূলিমাখা পথের পানে প্রতীক্ষমাণ নানির আঁখিযুগল প্রশান্তির পলক ফেলত। আমাদের মাথা-শরীরে আহ্লাদের পরশ বুলিয়ে নানি ব্যস্ত হয়ে যেতেন খাবারের বাসন সাজাতে।
নানির হাতের সব খাবারই বিশেষ পছন্দের ছিল। আমাদের আসার আগেই তিনি গাছের কলা কেটে মাটির কোলায় জাগিয়ে রাখতেন। সঙ্গে থাকত ওনার হাতের ভাজা গরম–গরম খই। নানি মাটির চুলায় খই ভাজার আয়োজন করতেন। আমরা চুলার পাশে পিঁড়ি পেতে বসে বিস্ময় নিয়ে তা দেখতাম। উনুন জ্বালিয়ে তার ওপর মাটির হাঁড়ি চাপিয়ে দিতেন। বালু গরম করা হতো। বালু খুব গরম হলে এর মধ্যে রোদে শুকিয়ে রাখা সোনালি ধান দিয়ে নাড়াচাড়া করতেন। ধানগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে খই হয়ে যেত। কী যে চোখধাঁধানো ছিল সেই দৃশ্য!
কলা দিয়ে খই, পৃথিবীর অন্যতম মজাদার খাবারগুলোর মধ্যে একটি। বিশেষ করে আমি আর আমার ছোট ভাই বেতের সেরে কলা ও খই নিয়ে সারা বাড়ি হেঁটে হেঁটে খেতাম। নানির হাতের মেরা পিঠার স্বাদও ঘোর লাগানো ছিল। তিনি সেদ্ধ মেরা পিঠা ঠান্ডা করে মাটির চুলায় পুড়িয়ে আমাদের দিতেন। গরম পিঠা ফুঁ দিয়ে দিয়ে খেতাম। পিঠার শরীর দিয়ে একটা পোড়া গন্ধ আসত, সেই গন্ধ পিঠার স্বাদ আরও বাড়িয়ে দিত।
নানাদের একান্নবর্তী পরিবার ছিল। মাঝখানে উঠান আর পাশ দিয়ে নানা ও তাঁর জ্ঞাতি ভাইদের ঘর। সব ভাইয়ের আবার কয়েকজন করে সন্তানসন্ততি। সবাই আমাদের মামা-খালা। সবাই মিলে সারা বাড়িকে হইহুল্লোড় আর উৎসবে মাতিয়ে রাখতাম। দিনমান দৌড়ঝাঁপ চলতেই থাকত। এমনকি রাতে চাঁদের আলোয়ও জমে উঠত বিভিন্ন রকমের খেলার আসর। চলত নাচ-গান, গল্প-কবিতা আর হাসির বহর।
দেখতে দেখতে হাওয়াই–মিঠাইয়ের মতো আনন্দের দিনগুলো শেষ হয়ে যেত। বেজে উঠত বিদায়ের ঘণ্টা। চলে আসার কথা শুনে ভেতরটা হু হু করত। খুব করে চাইতাম, যদি আরও কয়েকটা দিন থেকে যেতে পারতাম। আমাদের চাওয়া পূরণ হতো না। মাঝেমধ্যে না আসার জন্য এদিক-ওদিকে লুকিয়ে থাকতাম। কখনো কাজের চাপ থাকলে আব্বা আমাদের রেখেই চলে আসতেন। কাজের চাপ না থাকলে আমাদের খুঁজে বের করে সঙ্গে নিয়ে তবেই ফিরতেন।
ফিরে আসার দিন নানির মনের আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যেত, তাঁর মুখ দেখে সহজেই টের পেতাম। তিনি আমাদের চলে আসার কথা শুনে নাওয়া-খাওয়া শিকেয় তুলে দিতেন। তাঁর সঙ্গে আমরাও শামিল হতাম। বিদায়বেলায় নানি আঁচলে মুখ ঢেকে, পেছন–পেছন এসে প্রধান সড়ক পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যেতেন। তিনি আঁচলে মুখ ঢেকে রাখলেও আঁখিযুগলের ঘোর বর্ষা ঢেকে রাখতে পারতেন না। একটা সময় ঠিকই বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতেন। নানির সঙ্গে মা-সহ আমরাও কাঁদতাম। বাসে উঠে মন খারাপ করে জানালা দিয়ে তাকিয়ে মনে করতাম নানাবাড়ির স্মৃতি। বাড়িতে আসার পরও বেশ কিছুদিন লেগে যেত মন ভালো হতে। একটা সময় সব স্বাভাবিক হয়ে যেত। আমরা আবার আরও একটি ঈদের স্বপ্ন দেখতাম, উপলক্ষ খুঁজতাম নানাবাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার।
এখন আর নানাবাড়ির সেই চিরচেনা গন্ধ নেই; নেই আর আগের সেই আমেজ। নানা-নানিরা ইহকালের পাট চুকিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন পরকালের জগতে। মামা-খালারাও বিয়েশাদি করে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তাঁদের নিজস্ব সংসারজগতে। কত বছর হয়ে গেছে, অনেকের সঙ্গেই আর দেখা হয় না! একান্নবর্তী পরিবার প্রথা ভেঙে সবার নিজস্ব বাড়ির আলাদা দেয়াল উঠেছে। এখন চাইলেই আর এক উঠান মাড়িয়ে সবার বাড়ি যাওয়া যায় না। সবাই হয়তো এখন একা একা থাকতেই ভালোবাসেন। আধুনিকতার মোড়কে নিজেদের মোড়াতে ব্যস্ত হওয়া মানুষগুলো কখন যে সবার থেকে একা হয়ে গেছেন, টেরই পাননি। আধুনিকতা আর জীবনের দৌড়ে দৌড়াতে দৌড়াতে আমরাও হারিয়ে ফেলেছি নানাবাড়ির মায়ার বাঁধন। ভালো থাকুক আমাদের নীল ছেলেবেলা, সযত্নে গাঁথা থাকুক স্মৃতির মালা।
ব্লক জি, বনশ্রী, ঢাকা