দিবানিশি: গ্রামীণ জনপদের দিন-রাতের গল্প

‘ইয়া মাবুদ’ বলে বিকট এক চিৎকারে মধ্যরাতের সব নিস্তব্ধতা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল নিজাম। দুই ছেলেকে সরিয়ে দৃশ্যটা দেখল আশ্বাব তালুকদার। তালুকদারের তিন ছেলের মধ্যে ছোট নিজাম, মেজ আজম এবং সবার বড় আখতার। দেশ ছেড়ে যাওয়া এক হিন্দু পরিবারের ‘ঘোষভিটা’কে কেন্দ্র করে উপন্যাসের শুরু। বলছিলাম তরুণ লেখক আবদুল্লাহ আল ইমরানের সমকালীন উপন্যাস দিবানিশির কথা। ২০১৭ সালে অমর একুশে বইমেলায় ২০৬ পৃষ্ঠার এই বইটি প্রকাশ করে অন্বেষা প্রকাশন। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন লেখকের স্ত্রী সানজিদা পারভীন তিন্নি। গায়ের মূল্য ৩০০ টাকা হলেও পাঠকেরা ২০-২৫ শতাংশ ছাড়ে সংগ্রহ করতে পারবেন প্রথমাসহ অভিজাত বুকশপ থেকে।

অনুসন্ধানী একজন সাংবাদিক হিসেবে ইতিমধ্যে খ্যাতি কুড়ানো লেখক আবদুল্লাহ আল ইমরান তাঁর এই উপন্যাসের শুরুটা করেছেন অমাবস্যার নিশুতি রাতের বর্ণনা দিয়ে। উপন্যাসের পরতে পরতে রেখেছেন রহস্যের বাঁক। কৃষ্ণদের বসতভিটায় একটি মন্দির ছিল। জনশ্রুতি আছে, মন্দিরের নিচে কিংবা পার্শ্ববর্তী জমিতে খুঁড়লে রত্নভরা কলসি মিলবে। এরূপ সম্ভাবনার বার্তা দীর্ঘদিন ধরে কানকথা হয়ে ছড়িয়ে আসছে চানপুরার হাটে-ঘাটে, খেতখামারে। দেশত্যাগী হিন্দু পরিবারের কাছ থেকে ‘মন্দিরের সম্মান রক্ষার’ শর্তে ভিটেমাটি কিনে নেয় আশ্বাব তালুকদার।

ঘোষভিটার মালিকানা হাতে পেয়ে তালুকদার প্রথমেই মন্দিরের যাত্রাপথে বেড়া দিতে শুরু করেন। কিন্তু কেন? এদিকে বেড়ার জন্য খুঁটি পুঁততে গিয়ে সৃষ্টি হয় আরেক রহস্যজনক অধ্যায়ের। লোকমুখের শোনা গুপ্তধনের লোভে তালুকদার পরিবার বিভোর হয়ে পড়ে। ঘটনাক্রমে দুটি মাঝারি ধরনের কলসির সন্ধান পায় তালুকদারের ছেলেরা! লোকচক্ষুর আড়াল করতে রাতের আঁধারে সে কলসি আনতে গিয়ে হতবাক হয়ে যায় বাপ-বেটারা! ছোট ছেলে নিজামের চিৎকারের পর বাপ-বেটারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। ছেলেদের সরিয়ে কী এমন দেখতে পায় তালুকদার? রত্নভরা কলসিতে আসলে কী ছিল? সেই কলসি কি তারা পেয়েছিল? রহস্যের এক গোলকধাঁধা বাধিয়ে দেবে আপনার মনে।

এই উপন্যাসে পাঠক পরিচিত হবেন গ্রামীণ রাজনীতির প্রতিভূ আজমত চেয়ারম্যানের সঙ্গে। ঘোষভিটা নিয়ে তালুকদার পরিবারের সঙ্গে তিনি এক কুটিল খেলায় মেতে ওঠেন। রঞ্জু মেম্বার কিংবা বহুরূপী আজগরকে দিয়ে চলে সাম্প্রদায়িকতার উন্মাদনা সৃষ্টির পাঁয়তারা। লাইন ধরে ধরে এগিয়ে যেতে যেতে পাঠক যেন গ্রামের চিত্রাবয়ব চোখের সামনে দেখতে পাবেন।

প্রায় দেড় শ বছর আগে নবগ্রামে মহেরউদ্দিন ফকির ভক্ত–মুরিদ নিয়ে শুরু করেছিল এক নতুন তরিকা। চানপুরায় সেই তরিকার বিস্তৃত করেছিল লালমুদ্দিন ফকির। কালের পরিক্রমায় খলিফার টুপি এখন মায়মুনার বাবা খবিরউদ্দিনের মাথায়। মায়মুনার মা ও খবিরউদ্দিনের স্ত্রীর মৃত্যুর পর গুরুত্বপূর্ণ চোতাসহ একটি মাটির হাঁড়ি গায়েব হয়ে যায়। কে নিয়েছে সেই হাঁড়ি? রহস্যের আরেক পর্ব ঘাপটি মেরে আছে এখানে।

দক্ষিণাঞ্চলের নদীতীরের নির্ভীক, সাহসী, সংগ্রামী নারীর প্রতীক রাবেয়া। স্বামী মতলেব খাঁর রাগ উঠলে অসুরের শক্তি ভর করে শরীরে। স্বামীর নির্যাতন সহ্য করে পরিশ্রম, ধৈর্য আর পরম মমতায় টিকিয়ে রেখেছেন সংসার। স্বামী–সন্তান নিয়ে মায়ার সংসারে দোচালা টিনের ঘর তোলেন রাবেয়া। দক্ষিণাঞ্চলের নদীভাঙনের শিকার বহু গৃহহীন বধূর জীবনের মতো করে একদিন সুগন্ধার বুকে বিলীন হয়ে যায় রাবেয়ার স্বপ্নের বাড়ি। তবে নদী ভাঙার আগেই তীব্র বুকের ব্যথা নিয়ে চোখ বন্ধ করেন রাবেয়া। সেই চোখ কি আর খুলেছিল এই মায়ার সংসারে?
একই উদ্দেশ্যে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সোহেল আর জুয়েল দুই ভাইয়ের মধ্যে সোহেল চরিত্রটির জট খুললেও জুয়েল চরিত্রকে লেখক খোলসমুক্ত করেননি। প্রশ্ন জাগবে মনে, সে বেঁচে আছে কি না, সে কোথায় আছে? সোহেল ফিরলেও জুয়েল কেন ফিরল না?

ফকিরবাড়ির মেয়ে মায়মুনা একজন চালাক আর ধৈর্যশীল নারী। মায়ের মৃত্যুর খবর শুনে বাপের বাড়ি যাত্রাপথে যার সঙ্গে দেখা মিলবে পাঠকের। নদীপাড়ে দাঁড় করিয়ে রেখে লেখকের বর্ণনা, ‘নাতিদীর্ঘ যে নদীর ওপারেই থাকে তার প্রাণের মানুষেরা। অদূরে সবুজ চাদরে ঢাকা চানপুরার অস্পষ্ট অবয়ব দেখা যায়। কত কাছে, তবু কত দূরে।’ এই এক নদী দূরত্ব কি মায়মুনা অতিক্রম করতে পেরেছিল? প্রিয় মায়ের মুখ দেখা হয়েছিল তাঁর? নাকি মেনে নিতে হয়েছিল নিয়তি?
প্রায় দেড় শ বছর আগে নবগ্রামে মহেরউদ্দিন ফকির ভক্ত–মুরিদ নিয়ে শুরু করেছিল এক নতুন তরিকা। চানপুরায় সেই তরিকার বিস্তৃত করেছিল লালমুদ্দিন ফকির। কালের পরিক্রমায় খলিফার টুপি এখন মায়মুনার বাবা খবিরউদ্দিনের মাথায়। মায়মুনার মা ও খবিরউদ্দিনের স্ত্রীর মৃত্যুর পর গুরুত্বপূর্ণ চোতাসহ একটি মাটির হাঁড়ি গায়েব হয়ে যায়। কে নিয়েছে সেই হাঁড়ি? রহস্যের আরেক পর্ব ঘাপটি মেরে আছে এখানে।

ধর্ষণের অভিযোগে গ্রামছাড়া আজগর হঠাৎ করে গ্রামে ফিরে আসে। এসেই বাজারে মার্কেট করা শুরু করল। তার বিপুল অর্থকরীর উৎস কী? কোথায় পেল সে এত টাকা? রত্নভরা কোনো হাঁড়ির সন্ধান পায়নি তো?
হোক গ্রাম কিংবা শহর, ‘ভালোবাসা’ মানুষের কালের সঙ্গী, সাক্ষী প্রতিটি যুগের। শাহজালাল আর নূরীর ভালোবাসার কাহিনিও তেমনি অপূর্ব এক রোমান্টিকতার অনুভূতি জাগাবে পাঠকের হৃদয়ে। পুকুরঘাটে নূরী আর শাহজালালের অনুভূতির বিনিময়ের বর্ণনা যেকোনো পাঠককে চুম্বকার্ষিত করবে। সৎমায়ের কূটনীতি আর নূরীর অনিশ্চিত যাত্রা পাঠককে ক্ষণে ক্ষণে অনুরণিত করবে। শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছিল? সব প্রশ্নের উত্তর কি মিলেছিল?

মতলেব, আশ্বাব তালুকদার, খবিরউদ্দিন ফকির, আজগর, মায়মুনা, আজমত চেয়ারম্যান ও নূরীদের জীবনযাপনের দিকে নজর দিলে আমরা আমাদের চারপাশেই এমন চরিত্রের উপস্থিতি টের পাই। কাল্পনিক এই চরিত্রগুলো যেন আমাদের চারপাশের মানুষগুলোরই প্রতিচ্ছবি। লেখকের কল্পিত দৃশ্যপট যেন এখনো জীবন্ত। হাজার বছরের রাত বাড়লেও গ্রামীণ রীতিনীতিতে কোনো পরিবর্তন নেই।
একটা বইয়ে বহু চরিত্রের চিত্রায়ণ তবু কোনো চরিত্রের রং গুলিয়ে ফেলেননি লেখক। উপন্যাসে বহু চরিত্রের সফল প্রদর্শনী করেছেন লেখক। অন্য কোনো খ্যাতিমান লেখকের ধারা অনুসরণ না করে লেখক নিজস্ব ঢঙে অসাধারণ শব্দমালা গেঁথেছেন, যা নতুন লেখকদের জন্য অনুকরণীয়।

উপন্যাসটিতে লেখক মানবজীবনের নানা দিক সম্পর্কে তাঁর বেশ কিছু দর্শন তুলে ধরেছেন। যেমন ‘জগতে নিঃশব্দে কান্নার চেয়ে তীব্র কষ্টের আর কি কিছু আছে?’ কিংবা ‘জগতে যত কঠিন কাজ আছে, তার মধ্যে আনন্দ চেপে রাখা একটা।’ আবার ‘সত্যের চাইতে মানুষ মিথ্যা বিশ্বাস করে বেশি।’ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষ সম্পর্কে বলেছেন, ‘খেটে খাওয়া মানুষের আর কিছু থাকুক বা না থাকুক আত্মসম্মানবোধটা থাকে।’ গ্রামের মানুষ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘গ্রাম্য কৌতূহল বড় ভয়ানক। উত্তর না পাওয়া অবধি এরা যাবে না।’ এই নশ্বর পৃথিবী থেকে মানুষের অনিবার্য প্রস্থান বাস্তবতা মেনে নিয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘কারও না থাকায় সময় থেমে থাকে না। কারণ প্রকৃতি নিজেই শূন্যতা পছন্দ করে না।’

লেখক বেশ কিছু রোমান্টিক উক্তিও করেছেন। যেমন ‘খুনি, ধর্ষক, ডাকাতের মতো অপরাধীকেও আমরা ক্ষমা করে দিই, ফেরাই স্বাভাবিক জীবনে। কিন্তু ভালোবেসে অপরাধী মানুষগুলোকে আমরা সারা জীবন ক্ষমা করতে পারি না।’ ‘প্রকাশ্য ভালোবাসার জন্য তুমুল কাতরতা থাকলেও হৃদয়ের অপ্রকাশ্য গভীরতা মাপার ক্ষমতা কি সবার থাকে?’ এ ছাড়াও লিখেছেন, ‘খুব বেশি নিকটে থেকেও কেউ কেউ এক জনমের দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে না।’ ‘অতি আপনজনের কাছে নিজেকে সঠিক প্রমাণের চেষ্টার চেয়ে কষ্টের আর কিছু নেই।’ ‘নিজের অপরাধবোধ কাটাতে অন্যকে কষ্ট দেওয়ার মানে হয়?’

উপন্যাসে লেখক পরম যত্নে নানা স্থানে সূক্ষ্ম বর্ণনা দিয়েছেন। আমার বিশ্বাস এর ফলে পাঠক চানপুরা গ্রামটিকে জীবন্ত অনুভব করতে পারবেন। যেমন ঘোষভিটার মন্দিরের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘জ্বলতে জ্বলতে ক্ষয় হওয়া অসংখ্য মোমের শেষাংশ লেপটে আছে চারিধারে।’ আবার কেন ঘোষভিটা বিক্রি হলো তার কারণ জানাচ্ছেন কৃষ্ণের মুখে, ‘পিঠ দেয়ালে ঠেইকা গেছে বইলাই জমিজমা বেইচা কলকাতায় যাইতেছি।’ কৃষ্ণের জমি ভিটেমাটি বিক্রির বর্ণনায় মানবিক গল্প ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। এমনিভাবে ঘটনা ও আবহ বর্ণনায় লেখক মুনশিয়ানার স্বাক্ষর রেখেছেন।

একই উপন্যাসে বিভিন্ন অনুভূতির সুন্দর প্রকাশ ঘটেছে। অনেক চরিত্রের করুণ পরিণতি পাঠককে অবশ্যই বিস্মিত করবে। তবে কিছু আঞ্চলিক শব্দ ব্যাখ্যার অভাবে পাঠক কিছুটা বিড়ম্বিত হবেন। এ ছাড়া আমার কাছে কিছু অসংগতিও লেগেছে। যেমন আশ্বাস তালুকদার চান না ‘হিন্দুপাড়ার অন্যরা বাড়ির ওপর দিয়ে এসে মন্দিরে পূজা দেবে।’ এ কারণে তিনি ছেলেদের ডেকে মন্দিরে ঢোকার পথে বাঁশের ঘন বেষ্টনী তৈরি করার নির্দেশ দিলেন। এ ঘটনার ঠিক আগেই লেখক জানাচ্ছেন, ‘সপ্তাহ না পেরোতেই চঞ্চলতা হারিয়ে পরিত্যক্ত এক ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে যেন।’ মন্দিরের বর্ণনায় জানালেন মনসার ঘটিতে প্যাঁচানো দুটো ভক্তির মালা শুকিয়ে চুপসে গেছে। দেবীকে দুধ দেওয়া বাটিটা কালচে হয়ে গেছে। তাহলে প্রশ্ন জাগে, গত এক সপ্তাহে কি প্রতিবেশী হিন্দুরা পূজা দেয়নি? যদি না দিয়ে থাকে, তবে বেড়া দেওয়ার প্রয়োজন কী? লেখকের প্রথম ধাপের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, অন্য হিন্দুরা এখানে পূজা দিতে আসেননি। তাহলে পূজারিদের আগমন ঠেকাতে বেষ্টনী দেওয়ার যুক্তিটি কতটা সঠিক?

লেখক পরিচিতি: লেখক আবদুল্লাহ আল ইমরানের জন্ম খুলনায়। তিনি পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইটি সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবদুল্লাহ আল ইমরান ইতিমধ্যে পেয়েছেন যমুনা টেলিভিশন দুরন্ত বাংলাদেশ সম্মাননা। জিতেছেন ২১তম জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বের শ্রেষ্ঠ বক্তার পুরস্কার। পেশায় সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল ইমরানের এখন পর্যন্ত সাতটি বই প্রকাশিত হয়েছে। কালচক্র, এই সব ভালোবাসা মিছে নয়, হোম পলিটিকস, উড়ে যায় নীল টিপ ও হৃদয়ের দক্ষিণ দুয়ার উল্লেখযোগ্য।

বিতর্কবিষয়ক সম্পাদক, বন্ধুসভা জাতীয় পর্ষদ