গ্রামীণ অপবাদ, কুসংস্কারের বলি ‘কুসুম কুসুম প্রেম’

‘কুসুম কুসুম প্রেম’ চলচ্চিত্রছবি: সংগৃহীত
ফেরদৌস, মৌসুমীর পাশে নজর কাড়া অভিনয়ে মাতিয়ে রেখেছেন রিয়াজ। বাদল চরিত্রে রিয়াজের শিল্পীসত্তা অনবদ্য।

হতে পারত সুন্দর মিষ্টি প্রেমের মধুর মিলনের ফলনের একটা ছবি ‘কুসুম কুসুম প্রেম’। গ্রামবাংলার মেঠোপথ, জলতরঙ্গ, সবুজ ধানখেত, হাঁসের ঝাঁক, ফলবান বৃক্ষ—সবকিছুর সঙ্গে মিলিয়ে রোদ–বৃষ্টি, প্রকৃতির সান্নিধ্যে এত সুন্দর মায়াডোর, মরমিয়া প্রণয় বাঁধন; যা আবহমানকালের বঙ্গ সংস্কৃতিকে অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত করে। আমাদের সামনে ঘটনার ঘনঘটার পরতে পরতে জীবনের ছায়া, বিরাট আকাশের মতো ছবির ক্যানভাসে এনে তুলে ধরে। কিন্তু মানুষ ছাড়া তো গ্রামবাংলার এই সাজানো বাগান কখনো পরিপূর্ণতা পায় না। আর এই মানুষের মধ্যে কুসুমের মতো সুন্দর মিষ্টি রাইকিশোরী আছে, হাশেমের মতো বংশীবাদক গাঁইয়া প্রেমিক আছে, বাদলের মতো বন্ধু–অন্তপ্রাণ, বন্ধুর জন্য নিজের নীরব ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে দিতে পারার মতো মহৎ বান্ধব আছে, ধর্মের জিগির তুলে দিনে দুপুর রাতে বদমায়েশি করে বেড়ানো গ্রামীণ মুনশি আছে, অন্ধ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন বিচারের নামে প্রহসন নামিয়ে আনা কিছু মোড়ল মাতবর আছে, তুকতাক–ঝাড়ফুক করা কিছু ফকির, কিছু ভন্ড সাধক যাদের ভন্ডামি, কুসংস্কার অন্যায় অবিচার–লাঞ্ছনার হাতে ধর্ষিত হতে হতে বিবেক দংশনে পরাজিত প্রেমিক মনকে হেরে যেতে হয়। কুসুম আর অন্য কুসুমে পাপড়ি মেলতে পারে না। গহিন ব্যথার অন্ধকারে বংশীবাদক মিলিয়ে যায়। এই চরম সত্য ঘটনা হত্যা না আত্মহত্যা, মানুষের দরবারে মানুষের জন্য প্রশ্ন রেখে যায়। শেষ হয়েও হয় না শেষ। প্রেমের প্রকৃত পরিণতি ব্যথার দংশনে অশ্রুসজল কাতর করে তোলে। যা হতে পারত, তা হয় না। যা হয়, তা আমরা চাই না।

২০১১ সালে মুশফিকুর রহমান গুলজার তাঁর অসাধারণ কাহিনি, অসামান্য চিত্রনাট্য, চৌকস সংলাপ এবং দক্ষ পরিচালনায় তেমনই চলচ্চিত্র তুলে আনলেন ‘কুসুম কুসুম প্রেম’। নামের ব্যাঞ্জনা থেকেই পরিণতির বিস্ময় জাগে, আহা! এমন কেন হয়! এমন কেন হয়!

এই চলচ্চিত্রের কুসুম, ভিন্ন ভিন্ন সাজে সজ্জিত অভিনেত্রী মৌসুমী ফুলের মতো মানব প্রকৃতিকে মাতিয়ে রেখেছেন। শিল্পী সত্তায় তিনি যথেষ্ট সুন্দরী। বিন্দুমাত্র সাজগোজ না করেও ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালে দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারেন। কুসুমের প্রেমিক হাশেম মানে ফেরদৌস অভিনয় দক্ষতায় মৌসুমী ফুলের পাশে প্রজাপতির মতো সারাক্ষণই রঙিন পাখনা মেলে নেচে নেচে বেড়িয়েছেন। ‘গাঁইয়া’ প্রেমিকের অবোধ শিশুর মতো সহজ সরল সংলাপ মুগ্ধ করে। দীর্ঘদিন সন্তান না আসাতে প্রেমিকযুগল নানাজনের পরামর্শে গ্রামীণ অনেক টোটকা হেকিম–কবিরাজির সাহায্য নিয়েছেন। যৌনমিলন মুহূর্তের আবহে অবোধ হাশেম একসময় কুসুমকে বলে ওঠে, এসব করে আর কী হবে? সন্তান যখন আসে না। যৌনমিলন কি শুধু সন্তান জন্মের জন্য, শারীরিক সুখ উপভোগের জন্য নয়! আবার সরকারি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসায় যখন সন্তান আসার উপক্রম হয়, লাজুক কুসুম বলে ওঠে কদিন তুমি যা কাজ করেছ, এবার সুফল আসবেই। হাশেম বলে ওঠে, ও রাতের কাজ! এমন ছেলেমানুষি নিষ্পাপ সংলাপ ফেরদৌসের অভিনয়ে পরিপূর্ণতা পায়। ফেরদৌস আসলে শিশুর মতো কোমল আবার নিপুণ বোদ্ধার মতো প্রাজ্ঞ একজন শিল্পী।

গ্রামীণ টোটকা চিকিৎসায় দীর্ঘদিন সন্তান না আসার ফলে হতাশ হওয়া এবং সরকারি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে সন্তান আসা; এই দীর্ঘ পরিক্রমার মধ্যে স্পষ্ট জনসচেতনতার বার্তা আছে। আবার গ্রামের দোকানে এক যুবক কনডম কিনতে যায়। ধর্মের জিগির তুলে সারাক্ষণই আকামকুকাম করে বেড়ানো মুনশি বলে ওঠে, তোদের কি লজ্জা নেই? যুবক স্পষ্ট বলে, এই কনডম জিনিসটার কথা আগে জানা থাকলে দেশের এত জনসংখ্যা বাড়ত না। অন্য একজন মুনশিকে পরামর্শ দেয়, আপনিও এক প্যাকেট নিয়ে যান। বছর বছর সন্তান জন্ম দিতে দিতে বউয়ের তো কাহিল অবস্থা। সুন্দর একটি চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে এই বার্তাগুলো গ্রামীণ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারাটাও অনেক বড় বিষয়।

ফেরদৌস, মৌসুমীর পাশে নজর কাড়া অভিনয়ে মাতিয়ে রেখেছেন রিয়াজ। বাদল চরিত্রে রিয়াজের শিল্পীসত্তা অনবদ্য। অনন্য দক্ষতায় সৃষ্টিশীলতায় প্রতিভাষিত হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। বাদল নিজের মামাতো বোন কুসুমকে মায়ের ইচ্ছায় নিজের বাড়িতে এনে রাখে। কুসুমের কাপড় থেকে শুরু করে কোনো আদর যত্নের ত্রুটি রাখে না। কুসুমকে মন দিয়ে ফেলে। মনে মনে স্বপ্ন বোনে। নীরব প্রেমিক তা কখনো প্রকাশ করে না। কুসুম তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু হাশেমের প্রেমে পড়ে। দুজনের বিয়ে ঠিক হয়। বাদল প্রাণপ্রিয়াকে প্রাণাধিক বন্ধুর হাতে তুলে দেয়। বন্ধুর সমস্যায় বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ায়।

হাশেমকে চোর অপবাদ দেয় গ্রামের কিছু লোক। অভিযোগ ওঠে নিজের চাচি আম্মার ভাইয়ের গরু বিক্রি করা টাকা চুরি করেছে হাশেম। বাদল বিশ্বাস করে না। চোর ধরতে গ্রামের মুনশি বাটি চালান, চালপড়া, চটা চালান, ফকিরের কেরামতির আসর বসায়। সবাই মিলে হাশেমকে দোষী বানায়। বাদল এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। হিন্দু হোক বা মুসলিম সব ধর্মের এসব কুসংস্কার ছড়ানো মানুষেরা ভন্ড–প্রতারক। পরিচালক স্পষ্ট বার্তা দেন। টাকা হারিয়ে যাওয়ার প্রকৃত কারণ জানতে পারার পরে, বাদল হাতে লাঠি তুলে নিয়ে মুখোশ খসে পড়া সব ভন্ডদের একধারসে পেটাতে শুরু করে। কিন্তু হায়! যে বন্ধু হাশেম আর কুসুমের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তার এই লড়াই, চোর অপবাদ নিয়ে চরম অপমানে, নির্যাতনে, বিবেকের দংশনে দুজনেই ততক্ষণে বিষ পান করে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গিয়েছে। এই অংশে শুধু রিয়াজ নয়, ফেরদৌস আর মৌসুমীর অভিনয় চিরকালীন ভাস্বর হয়ে থাকবে।

মুনশি চরিত্রে এটিএম শামসুজ্জামান নজরকাড়া অভিনয় করে গিয়েছেন। একটি চলচ্চিত্র শুধু নায়ক–নায়িকানির্ভর নয়। পার্শ্ব চরিত্রের জন্যও অনেক বড় জায়গা থাকে। এটিএম শামসুজ্জামানের মতো কিংবদন্তি শিল্পী এই জায়গা আপন দীপ্তিতে মুখরিত করে রেখেছেন। আবার ক্ষণিকের জন্য কেউ ক্যামেরার সামনে এলেও তিনি ফেলে দেওয়ার মতো নন। গ্রাম্য গুণিন অমল বোস সংক্ষিপ্ত পরিসরে অনবদ্য অভিনয় দক্ষতায় কাহিনির চাবিকাঠি হয়ে উঠেছেন। প্রবীর মিত্র, খালেদা আক্তার কল্পনা, নাসিমা খান—প্রত্যেকেই অসামান্য। ইমন সাহার সুর, মজিবুল হক ভুঞার চিত্রগ্রহণ, সহিদুল হকের সম্পাদনা মনে রাখার মতো। সুন্দর গানগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছেন কনক চাঁপা, এন্ড্রু কিশোর, মনির খান, পলাশ, সেলিম, সুবীর নন্দী, সামিনা চৌধুরী।

‘কুসুম কুসুম প্রেম’ আসলে অনাগত সুন্দর দিনের ফুল ফোটানোর বাসনা। এই প্রত্যয় জেগে থাক।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত