‘আঁরা চাটগাঁইয়া ফোয়া, মেডিত ফরলেই লোয়া’

আইয়ুব বাচ্চু (১৯৬২—২০১৮)

মা–বাবা চাইতেন না যে ছেলে গানবাজনা করুক। আইয়ুব বাচ্চুর বাবা বলতেন, বাড়িতে বাউলদের কোনো জায়গা নেই। কোনো এক সময় অভিমান করে বড় শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে মাত্র ৬০০ টাকা পকেটে নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। এলিফ্যান্ট রোডের একটি হোটেলে ওঠেন। হোটেলের লবিতে পাটি বিছিয়ে মেঝেতে থাকতেন। স্বপ্নবাজ এই তরুণ একসময় কঠোর অনুশীলন, সাধনা ও একাগ্রতায় গায়ক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরীর এনায়েত বাজারের ৩৪৪ জুবিলী রোডে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ডাকনাম ছিল রবিন। আইয়ুব বাচ্চু নামেই সবাই চেনে। দাদাবাড়ি পটিয়া উপজেলার খরনা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে। নানা–নানিরা আইয়ুব বাচ্চুকে আদর করে ‘বাঁশি’ বলে ডাকতেন।

তিনি ব্যক্তিগত জীবনে বেশ সদালাপী ও মিষ্টভাষী ছিলেন। তাঁর সৃষ্টিশীলতা ছিল আধুনিক। বিনয়ী আইয়ুব বাচ্চু সদা হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত উপস্থাপনা ও গান গেয়ে মুগ্ধ করতেন শ্রোতাদের। মানুষের সঙ্গে প্রথমে সালাম দিয়ে পরিচিত হতে পছন্দ করতেন। একবার এক কনসার্টে বাচ্চু ভাইকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করার সময় হাসি দিয়ে তিনি আমাকে বললেন, বাড়ি হন্ডে (বাড়ি কোথায়)? চাটগাঁ নে, আমি বললাম, ভাইয়া পটিয়া। বাচ্চু ভাই হেসে বললেন, বদ্দা আঁইও পইট্ট্যা, জড়িয়ে ধরলেন। বাচ্চু ভাই সব সময় বলতেন, ‘আঁরা চাটগাঁইয়া ফোয়া, মেডিত ফরলেই লোয়া।’

চট্টগ্রামে রুপালী গিটার ভাস্কর্য
ছবি: লেখক

আইয়ুব বাচ্চুর প্রতিটি গানের পেছনে একটা গল্প আছে। অজানা গল্প। প্রতিটি কনসার্টে মা-মাটি ও মাতৃভূমির প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ পেত এবং তরুণ সমাজকে অন্ধকার জগৎ থেকে বিশেষ করে মাদক ও তামাক থেকে দূরে থাকার জন্য তিনি উপদেশ দিতেন। কনসার্ট শেষ করতেন জাতীয় সংগীতের শেষ চরণ দিয়ে—মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি, সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।

প্রথম আলোর মাদকবিরোধী কনসার্ট দেখার জন্য আধভেজা বৃষ্টিতে বিকেলে ফয়’স লেকে ছুটে গিয়েছিলাম। তাঁর গান ও উপস্থাপনা মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। তরুণদের দুই হাত তুলে শপথ করাতেন—মাদককে না বলুন। আইয়ুব বাচ্চুর গান মানে মনে দুটি হৃদয়ের সবিনয় নিবেদন, ভালোবাসার রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া। হৃদয় নিয়ে বলেছেন, মানুষের হৃদয় অনেকটা কাচের মতো, যেমন কাচ হাত থেকে পড়ে গেলে চূর্ণ হয়ে যায়। দেশের প্রতি ছিল অসম্ভব টান। তিনি বলতেন, দেশকে ভালোবাসতে হবে সবার আগে। মাকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। কেননা মা কষ্ট পেলে দেশ কষ্ট পাবে। কেউ যেন তাঁদের মা–বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে না পাঠায়।

আইয়ুব বাচ্চুর খুব ইচ্ছা ছিল দেশের তরুণ গিটার বাজিয়েদের নিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা। সেরা গিটার বাজিয়েদের পুরস্কার হিসেবে নিজ হাতে দেবেন তাঁর প্রাণের চেয়ে প্রিয় গিটার। হয়নি গিটার প্রতিযোগিতা। চট্টগ্রামে তিনি এবি লাউঞ্জ করতে চেয়েছিলেন নব্য ব্যান্ডশিল্পীদের জন্য। যেখানে নব্য গায়কেরা গিটার বাজাবেন এবং গাইবেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল, চট্টগ্রাম শহরে সুন্দর একটি বাংলো করার। পটিয়ায় গ্রামের বাড়িতে একটি হাসপাতাল করারও স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সেগুলো পূরণ করে যেতে পারেননি। তার আগেই এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে না–ফেরার দেশে পাড়ি জমান রুপালি গিটারের জাদুকর আইয়ুব বাচ্চু। দিনটি ছিল ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর।

বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা