ঈদের চাঁদ চুরি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এই লাল-নীল বাতির ঢাকা শহর সত্যিই জাদু জানে। গোপন ইশারায় কাছে ডাকে। ছবির মতো এই শহরকে কখনো কখনো স্বপ্ন পূরণের বাতিঘর মনে হয়। অথচ প্রতি রাতে লাখো মানুষের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয় এই রঙিলা শহরের আকাশ-বাতাস। লাখো মানুষের হতাশা ও বিষণ্নতার গান শোনায় শহুরে হাওয়া। বহিরাবরণে এই শহরকে জাদুর শহর মনে হলেও এখানে গোপন অনেক গল্প আছে। বামুন হয়ে চাঁদকে স্পর্শ করার মতো কিছু মানুষের দুঃসাহস আছে। সফলতার সিঁড়িতে পা পিছলে পড়ে পঙ্গু হওয়ার নিদারুণ গল্প আছে। হঠাৎ করে আকাশ হওয়ার লোভ আছে। এই শহরে বেঁচে থাকার ইচ্ছেগুলোর তুমুল দম আছে। উঁচু উঁচু অট্টালিকাগুলো যেন কেবলই আকাশ ছুঁতে চায়।

এই শহরে কোনো দিন নেই, রাত নেই। এখানে দিনরাত্রি সমান। শহরের এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্তে মানুষ ছুটে বেড়ায়। কেউ শহরে ছুটে আসে একটুখানি আশ্রয়ের আশায়। কেউ কেউ ছুটে আসে শূন্য পেটের যন্ত্রণা দূর করার অভিপ্রায়ে। রতনও তাদেরই একজন। খাল–বিল–নদীর দেশ থেকে সে এসেছে। বরিশাল থেকে সোজা লঞ্চে করে সদরঘাট। তারপর অঞ্জন দত্তের বেলা বোস গানের মতো- ‘কসবার ঐ নীল দেয়ালের ঘর/ সাদা-কালো এই জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার শহরে/ তোমার আমার লাল-নীল সংসার।’—টোনাটুনির গল্পের মতোই রতন ও শাহিদা লাল নীল সংসার পাতে শহরের বুকে।

হঠাৎ শাহিদার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে রামিশা প্রশ্ন করল, ‘মা, আমরা কই যাচ্ছি? বাবা কি আমার জন্য লাল ফ্রক কিনতে গেছে?’ শাহিদা কোনো উত্তর দিতে পারে না। তার দুচোখ উপচে বান ডেকেছে নোনা জল।

রতন নতুন একটা কাজ জোগাড় করেছে। তিন দিন ধরে একটা সেমাই কারখানায় যাচ্ছে সে। গত দু-মাস সে কোথাও কোনো কাজ পায়নি। বিনা নোটিশে চাকরি হারিয়ে দিশাহারা হয়ে গিয়েছিল। পরিচিত এর কাছে, ওর কাছে কত ধরনা দিয়েছে। কেউ কথা রাখেনি। একটা কাজের বন্দোবস্ত কেউ করে দেয়নি। শাহিদা বিবির মাটির ব্যাংকে জমানো টাকাগুলোও দ্রুত ফুরিয়ে যায়। সবশেষে হাত পড়ে শাহিদার কানের দুলে। ক্লাশ ফাইভে বৃত্তি পাওয়ার পর কৃষক বাবা গড়ে দিয়েছিলেন এই দুলজোড়া। চার আনা স্বর্ণের দামেই এই শহরে স্বপ্ন কিনতে রতন প্রতিদিন ঘুরে বেড়িয়েছে। এটা ওটা ফেরি করে দিনাতিপাত করেছে। জ্যামিতিক হারে বেড়েছে দেনার পরিমাণ। কোনো কূলকিনার পাচ্ছিল না। মাঝদরিয়ায় নিমজ্জিত কচুরিপানার মতো উত্তাল ঢেউয়ে একবার সে তলিয়ে যায়, আবার হঠাৎ ভেসে ওঠে। এই ভাসা-ডোবার খেলা খেলতে খেলতেই একদিন ওপারের ঘাটে তরী ভিড়ায় রতন। রতন-শাহিদার ঘরেও কদাচিৎ সুখ আসে। আবার সেই সুকপাখি ওড়ে চলেও যায়। তারপর দীর্ঘ বিরতি নেয় সুকপাখি। রতনদের ঘরে আর সুখ আসে না। ভাঙা দরজা জানালা দিয়ে শীতের কনকনে হাওয়ার মতো ঘরে কষ্ট ঢুকে। রতন শাহিদাদের হাড় থেকে অস্থিমজ্জা পর্যন্ত হাঁটি হাঁটি পা পা করে পৌঁছে যায় বেদনারা। এত দুঃখ-দুর্দশার ভেতরও রতন-শাহিদার ঘরে জন্ম নেয় পুতুলের মতো মেয়ে রামিশা! রামিশার জন্ম এই রঙিলা শহরেই। তাই রতন মেয়ের নামটা রাখে শহুরে ধাঁচে। গ্রামে জন্ম হলে রামিশার নাম হয়তো জরিনা কিংবা রহিমাই হতো।

সামনেই রোজার ঈদ। খুব ব্যস্ততায় কাটছে রতনের দিন। কারখানায় দম ফেলার মতো সুযোগ নেই। সেমাই বানানোর প্রক্রিয়া সহজ হলেও খুব পরিশ্রমের কাজ। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য মহাজন পুরস্কারও ঘোষণা করেছে—যারা এই মাসে নির্ধারিত আট ঘণ্টার পরও অতিরিক্ত আট ঘণ্টা কাজ করবে; তাদেরকে অতিরিক্ত দুই হাজার টাকা বোনাস দেওয়া হবে। রতন ঘোষণাটা শুনেই খুশি হয়ে গেল। ঈদের আগেই তাকে মুদিদোকানের বাকির টাকা পরিশোধ করতে হবে। না হলে স্বপন বণিক যেকোনো সময় রাস্তাঘাটে বেইজ্জত করতে পারে তাকে। তা ছাড়া ঘরের ভাড়াও এক মাসের বকেয়া পড়েছে। চাঁন রাইতের আগেই দিতে হবে। খাটাশ সুরত আলীর নজর খুব একটা ভালো না। ঘর ভাড়ার অসিলায় দিনে কয়েকবার শাহিদাকে বিরক্ত করে। আকারে ইঙ্গিতে খারাপ কিছু বোঝাতে চায়। সুরত আলীর বারবার ঘরে আসার রাস্তাটা বন্ধ করতে হবে। এসব হিসাবনিকাশ করে আকাশের দিকে মুখ তুলে রতন আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করে। দেনা-পাওনার অংকটা একদম খাপে খাপ মিলে গেছে তার। বেতন ও ওভারটাইমের টাকা দিয়ে রতন দেনা পরিশোধ করবে। আর বোনাসের দুই হাজার টাকা পেলে রামিশার জন্য লাল টুকটুকে একটা ফ্রক ও জুতা কিনবে। মাঝেমধ্যে মেয়ের সঙ্গে লাল ফ্রকের গল্প হয়। ঈদের দিনের জন্য একটা ব্রয়লার মুরগি ও এক কেজি পোলাওয়ের চাল কিনবে। ব্যস হয়ে যাবে। ঈদটা দারুণ কেটে যাবে। এসব ভেবে ভেবে রতনের মনে ঈদ আনন্দ কাজ করছে। হাতে পায়ে দারুণ জোশ এসেছে। সে দ্বিগুণ বেগে কাজগুলো করছে। রতনের প্রাণশক্তির উদ্যমটা মহাজনের চোখ এড়ায় না। রতনের পরিশ্রম দেখে মহাজনও মুচকি হাসেন। সেমাইয়ের স্তূপ বড় থেকে আরও বড় হচ্ছে। গোডাউনে সেমাইয়ের কার্টনের স্তূপ জমছে। তা দেখে মহাজনের ঠোঁটেও ঈদের চাঁদের মতো হাসি উঁকি দেয়!

প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে আল মদিনার সেমাই। কারখানার চিপা গলিতেই কাক ডাকা ভোরে এসে দাঁড়ায় কয়েকটা ট্রাক ও পিকআপ। সেমাইয়ের কার্টনবোঝাই শেষে গাড়িগুলো ছুটে যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। রতন ষোলো ঘণ্টা ডিউটি করে ঠিকমতো ঘুমানোর সময়ও পায় না। দিন শেষে তার শরীরে ক্লান্তি এসে ভর করে। কারখানায় আসলেই বুকে দম চলে আসে। বোনাসের কথা মনে আসলেই শরীরে শক্তি এসে জড়ো হয়। মেশিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রোবটের মতো রতনও কাজ করে। কদিন ধরে মাল লোড করার লোকের আকাল পড়েছে। ঘণ্টা প্রতি একশো টাকার মজুরিতে গাড়িতে মাল লোড করছে রতন। মনে মনে স্বপ্ন দেখে এখান থেকে অতিরিক্ত হাজার দুয়েক টাকা পেলে বউয়ের জন্যও একটা শাড়ি কিনবে। সঙ্গে ম্যাচিং কাচের চুড়ি। এক কেজি গরুর মাংসও কিনতে পারবে। কত দিন ঘরে গরুর মাংস ঢোকে না। রঙিন ফিতা বাঁধা চুলের দুটো বেণি এসে বুকের ওপর পড়লে শাহিদাকে অষ্টাদশীই মনে হবে। গরিবের ঘরে শাহিদাকে ধবল পূর্ণিমার মতো লাগে। কাজের ভেতরে রতন কল্পনায় শাহিদাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। আদর করে। অথচ ব্যস্ততার কারণে কয়েক দিন ধরে শাহিদাকে সে বুকে জড়িয়ে ধরার সময় পায় না। দিন শেষের সবটুকু ক্লান্তি এসে যখন ভর করে রতনের শরীরে; তখন নিশ্চল গাছের মতো নিজেকে আবিষ্কার করে। রাতে শোবার সময় শাহিদার সাংসারিক অনেক কথার এলোমেলো উত্তর দিতে দিতে হঠাৎ ঘুমের দেশে চলে যায় সে। ইদানীং রামিশাকেও আদর করা হয় না। যখন রতন ঘরে ফিরে আসে তখন মেয়ে ঘুমিয়ে থাকে। আবার যখন সাহ্‌রি খেয়ে কাজের জন্য বের হয়ে যায়, তখনো মেয়ে ঘুমের দেশে থাকে। মাঝেমধ্যে রতনের কাছে নিজেকে যন্ত্রমানব মনে হয়। এত পরিশ্রম ও ত্যাগের পরে মহাজনের কাছ থেকে সব টাকা পেলে তার সব দুঃখ-কষ্ট উবে যাবে। অনেকটা প্রসূতি মায়ের মতো। ভূমিষ্ট সন্তানের মুখের দিকে তাকালেই নাকি মা তার পাঁজরের সত্তরটা হাড় ভাঙার মতো প্রসবকালীন ব্যথাও ভুলে যায়। রতনও হয়তো এসব ভুলে যাবে।

এক সপ্তাহ পর ঈদ। হঠাৎ সকাল ৯টার দিকে আল মদিনা সেমাই কারখানায় রেইড পড়ে। পুলিশসহ ম্যাজিস্ট্রেট সেমাই কারখানায় হানা দিয়েছে। নামকরা সব ব্র্যান্ডের নকল সেমাই এখানে তৈরি হয়—এমন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালায় ম্যাজিস্ট্রেট। এ ছাড়াও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রস্তুতকৃত এই সেমাই খেলে মানুষের পরিপাকতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি হবে। ভেজাল ডালডা ও পোড়া মবিলে ভাজা হয় চাক চাক সেমাই। খাদ্যে ভেজাল ও নকল পণ্যের দায়ে কারখানা থেকেই গ্রেপ্তার করা হয় মহাজনকে। কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদেরকেও গ্রেপ্তার করে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দুই মাসের জেল দেন ম্যাজিস্ট্রেট। সিলগালা করা হয় কারখানাটি। উৎসুক জনতার ভিড় ঠেলে সবার সঙ্গে রতনকেও পুলিশের গাড়িতে তোলা হচ্ছে। টেলিভিশনের সাংবাদিকদের ক্যামেরায় চলছে লাইভ সম্প্রচার। পত্রিকা অফিসের লোকজনের ক্যামেরার ফোকাস; ক্লিক ক্লিক আওয়াজ। সেদিকে রতনের কোনো মনোযোগ নেই। হাতকড়া পরা রতনের চোখ সোজা সামনের সড়কের দিকে। এই পথ ধরেই সে প্রতি রাতে ঘরে ফিরে। সে ঘরে ফিরলেই শাহিদার সারা দিনের অপেক্ষার অবসান হয়। রামিশার ছোট ছোট আবদার পূরণ হয়। অথচ আজ থেকে শাহিদা-রামিশার অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হয়ে গেল। তাদের ঈদের চাঁদ চুরি হয়ে গেল। এসব ভাবতে ভাবতেই গাড়িগুলোর সাইরেন বেজে ওঠে। সব ভিড়ভাট্টা ঠেলে গাড়িগুলো মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেল।

দুই.
রতনের জেলে যাওয়ার খবর শাহিদার কাছে পৌঁছে গেছে। খবরটা শুনেই সুরত আলীর বিভৎস চেহারাটা শাহিদার সামনে ভেসে ওঠল। মুদি দোকানি স্বপন বণিকের চিল্লাচিল্লি যেন কানের কাছে শূল হয়ে বিঁধছে। সবই কল্পনা। রাত বাড়ছে। আশপাশে ঈদের উৎসবের আমেজ যেন লেগে গেছে। শুধু শাহিদার ঘরে ঈদটা চুরি হয়ে গেল। শাহিদা, রামিশাকে বুকে শক্ত করে ধরে আছে। হঠাৎ কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রামিশার হাত শক্ত করে ধরে ঘর থেকে এক কাপড়ে চুপিচুপি বের হয়ে যায়। অন্ধকার গলি পেরিয়ে বাবুবাজার ব্রিজের ফুটপাত ধরে তারা দ্রুত পায়ে হাঁটে। কোথায় যাবে শাহিদা? কিছুই জানে না সে। নিয়তির হাতে নিজেকে সঁপে হাঁটছে। এই শহর থেকে তাকে পালাতেই হবে। পাওনাদারদের হাত থেকে বাঁচতে সে পালিয়ে যাচ্ছে। বাবুবাজার ব্রিজ থেকেই দেখা যাচ্ছে সদরঘাটের সারি সারি লঞ্চ। লাল-নীল লাইটের আলো বুড়িগঙ্গার বুকের ছোট ছোট ঢেউয়ের ওপর পড়ছে। প্রতিবিম্বিত সেই আলো দারুণ এক জলছবি এঁকে যাচ্ছে। হঠাৎ শাহিদার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে রামিশা প্রশ্ন করল, ‘মা, আমরা কই যাচ্ছি? বাবা কি আমার জন্য লাল ফ্রক কিনতে গেছে?’ শাহিদা কোনো উত্তর দিতে পারে না। তার দুচোখ উপচে বান ডেকেছে নোনা জল। গোপনে শাড়ির আঁচল দিয়ে সে চোখের জল মুছে। তারপর রামিশাকে বলল, ‘একটু দ্রুত হাঁট রে, মা।’

মাধবপুর, হবিগঞ্জ