বিনিয়োগ
কেন ও কীভাবে বিনিয়োগ করব
লেখাটি ২০২৪ সালের জুনে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের দশম সংখ্যা থেকে নেওয়া।
আমাদের দেশে আমরা ছোটবেলা থেকে টাকাপয়সা নিয়ে কথা বলাটাকে অনেকটা ট্যাবু করে রেখেছি। জীবনে চলার জন্য, ভালোভাবে থাকার জন্য, ভালো কাজ করার জন্য টাকা লাগবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
টাকা যেহেতু লাগবে, তাহলে তা আসবে কোথা থেকে? উত্তর সহজ। চাকরি, ব্যবসাসহ বিভিন্ন কাজ করে। এটা তো সবাই করে। সারা জীবন তো মানুষ কাজ করতে পারবে না; তবে খরচ সারা জীবনই করতে হবে। এখানেই দরকার বিনিয়োগের। যেন যখন কাজ করতে পারবে না একজন মানুষ, তখন সে খরচ চালাতে পারে। এ ছাড়া জীবনমান উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ লাগবেই। বিনিয়োগই একমাত্র অর্থকে যথেষ্ট পরিমাণ বাড়াতে পারে।
এখন জানতে হবে বিনিয়োগ করতে গেলে ঝুঁকি কেমন ও কীভাবে করব? ঝুঁকির ক্ষেত্রে আমরা বিনিয়োগকে তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। ঝুঁকিবিহীন, কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ। প্রথমেই আসি ঝুঁকিবিহীন বিনিয়োগের ব্যাপারে। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মেয়াদি সঞ্চয়পত্র, বন্ড, সরকারি–বেসরকারি ব্যাংকের বিভিন্ন মেয়াদি বিনিয়োগকে ঝুঁকিবিহীন বিনিয়োগ হিসেবে ধরতে পারি। এসবের মধ্যে সঞ্চয়পত্র সাধারণত সবচেয়ে বেশি মুনাফা দেয় (১০ থেকে ১২ শতাংশ) এবং কর রেয়াতের সুবিধাও দেয়; যেখানে ব্যাংকের মেয়াদি বিনিয়োগে ৫ থেকে ৮ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যায়।
কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের মধ্যে আছে ভালো মানের শেয়ারে বিনিয়োগ, মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায় বিনিয়োগ, ভূসম্পত্তিতে বিনিয়োগ ও স্বর্ণে বিনিয়োগ। সাধারণত এসব বিনিয়োগে বাৎসরিক ২০ থেকে ৫০ শতাংশ মুনাফা করা যায়। ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের মধ্যে থাকে ভালো মানের নয় এমন কোম্পানিতে বিনিয়োগ, স্টার্টআপ ব্যবসায় বিনিয়োগ, নতুন ইউটিউব, ফেসবুক, এক্স, ইনস্টাগ্রাম চ্যানেল, কিছু ক্ষেত্রে নতুন পণ্য বা সেবা আমদানি বা বিপণনসহ আরও কিছু ব্যবসা। এসবে সাধারণত ৩৫ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে মুনাফার পরিমাণ যত বাড়ে, ততই ঝুঁকির পরিমাণও বাড়ে। এর অর্থ বিনিয়োগের পুরো অর্থ হারানোর আশঙ্কা বাড়তে থাকে।
বিনিয়োগের শুরু হওয়া দরকার ছোটবেলা থেকে। অল্প করেই হোক। কিন্তু শুরু হোক। স্কুলের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে পোস্ট অফিসে জমানো হতে পারে, স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানের জন্য স্টল দেওয়া থেকে হতে পারে যেকোনো কিছু। অভ্যাসটা তৈরি করতে হবে। আমাদের অভ্যস্ত হওয়া দরকার হিসাবি ঝুঁকি নেওয়ার জন্য। মনে রাখতে হবে, কোনো রকম ঝুঁকি না নেওয়াই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।
সাধারণত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ৪০-৩৫-২৫ এই নিয়ম অনুসরণ করলে বিনিয়োগ থেকে ঝুঁকির তুলনায় মুনাফা ভালো হয়। এই নিয়ম অনুসারে আপনার বিনিয়োগের ৪০ শতাংশ হবে ঝুঁকিহীন বিনিয়োগে, ৩৫ শতাংশ হবে কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে এবং ২৫ শতাংশ হবে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে। এতে মূলধন হারানোর ঝুঁকি যেমন কম থাকে, তেমনি মুনাফা করার সম্ভাবনাও বাড়তে থাকে।
এসবের পাশে আরেক ধরনের বিনিয়োগ আছে, যা আমরা খুবই অবহেলা করি, সেটা হলো নিজের ওপর বিনিয়োগ। এটা মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। নিজের সুস্বাস্থ্যের জন্য বিনিয়োগ ও কর্মোন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ। এখনকার যুগে এই বিনিয়োগ খুবই প্রয়োজনীয় এবং অন্য বিনিয়োগগুলো এটার ওপরে অনেকটাই নির্ভরশীল।
সুস্বাস্থ্যের জন্য বিনিয়োগ বলতে সুষম আহার, স্বাস্থ্যকর খাবার, সঠিক চিকিৎসা, পরিমিত শরীরচর্চার জন্য বিনিয়োগকে বোঝানো হয়েছে। অনেকের মনে এ ধারণা আসতে পারে যে আমরা তো খাবার ঠিকই খাই, ডাক্তারও দেখাই রোগ হলে; তাহলে আলাদা বিনিয়োগের ব্যাপারে কথা আসছে কেন? কারণ, আমরা রোগ হলেই বা কোনো শারীরিক অসুবিধা অনুভূত হলেই তবে ডাক্তার দেখাই। কিন্তু নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলে রোগ বাড়ার আগেই সেটা নির্ণয় করা যায় এবং চিকিৎসা সহজ হয়। খাবারের ব্যাপারটাও তা–ই। প্রত্যেকের শরীর আলাদা। প্রত্যেকের খাদ্যের দরকারও ভিন্ন। পুষ্টিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করে সেটা ঠিক করাটা আমাদের কাছে খরচ হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি একটা বিনিয়োগ। আমাদের শরীর একটাই। এর কোনো প্রতিস্থাপন বা অদলবদলের সুযোগ নেই। শরীর ভালো না থাকলে সব কাজেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা জীবনকে জটিল থেকে জটিলতর করে। তাই শরীরের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যেরও খেয়াল রাখতে হবে।
এর পরের বিনিয়োগ হলো নিজের আত্মোন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ। নিজের লেখাপড়া, কর্মদক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিষয়ভিত্তিক ও সফট স্কিলভিত্তিক বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য বিনিয়োগ হলো আত্মোন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ। এটি যে কারও কর্মজীবনে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে অত্যাবশ্যক এবং এটি জীবনভর চলমান প্রক্রিয়া। বর্তমান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে নিজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগের প্রয়োজন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব সময় মনে রাখতে হবে অস্বাভাবিক মুনাফার প্রলোভনে প্রলুব্ধ হওয়া যাবে না। অস্বাভাবিক মুনাফা দেখানো বেশির ভাগ পন্থাই প্রতারণাপূর্ণ হয়ে থাকে এবং মূলধন হারানোর আশঙ্কা প্রবল। বিনিয়োগের লক্ষ্য হওয়া উচিত পরিমিত পরিমাণের টেকসই মুনাফা লাভ। তাহলেই জীবন হবে সহজ, ভবিষ্যৎ হবে সুন্দর।
অর্থ সম্পাদক (২০২৩), বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ