ফসল–দার্শনিক রফিক চাচা
সকালের সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠেন। নামাজ বাদ যায় না। সূর্যাস্ত পর্যন্ত সোনার দেশের সোনার মাঠে সোনার ফসল তুলে মানুষের জীবিকা মেটান। সহস্র কষ্ট, দুর্দশা, হতাশা, হাসি, কান্না, সুখ ও দুঃখ নিয়ে রফিক চাচার জীবন।
আমরা যে এত সুন্দর সুন্দর নামের ফসল, তরকারি খেয়ে ক্ষুধা মিটাই, সেগুলো কীভাবে আসে একমুহূর্ত ভেবেছেন? ফুলের মতো ফুলকপি, তৃণ সবুজ কাঁচা মরিচ, লাল টমেটো, লাউ, পেঁপে, বেগুন, করলা, শিম, কচু, পটোল, ঝিঙা, মুলা, পুঁইশাক, লালশাক, পালংশাক ইত্যাদি কীভাবে উৎপাদন হয়?
আজ একজন কৃষক সম্পর্কে বলব। যিনি সব কৃষিতে অভিজ্ঞ। একজন কৃষিশিল্পী! আমাদের জন্য ফসল উৎপাদন করেন।
প্রচণ্ড শীতের ঠান্ডায় আপনি যখন লেপের নিচে নিদ্রায় বিভোর, তখন রফিক চাচা কুয়াশা-মাখানো বিলের মধ্যে কাজ করেন। নিজের সন্তানের মতো মায়াভরে যত্ন নেন সোনার ফসলের। আমাদের কাছে শীত মানে কত কিছু! কিন্তু রফিক চাচার কাছে শীত মানে ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, মুলা ও শিমখেতে কৃষি–বুদ্ধিজীবীর মতো কাজ করা। দেশে খাদ্য সরবরাহ করা। যে মাঠে কাজ করেন, সেই মাঠের সামনের ১০ ফুট স্পষ্ট নয়, মানে একেবারে অদৃশ্য। তীব্র কুয়াশা আর ঠান্ডায় যে হাত টনটন করবে আপনার। আঙুলে কনকনে ঠান্ডায় ভাঁজ পড়ে যায়। কিন্তু ওনার মনোযোগ কাজে। শীতের কুয়াশা ও ঠান্ডা এসবে তাঁর নজর নেই।
কাঁচা মরিচ যে খান! জানেন কি কত পর্যায়ে এই চাষ হয়? প্রথমে সঠিক জায়গা নির্ধারণ করা। খনন করে বীজ ছিটিয়ে ফেলতে হয়। চারা গজায় কিছুদিন পর। সেই চারা অন্য জায়গায় রোপণ করা হয়। প্রতিদিন পানি দেওয়া। একটু একটু সতেজ হওয়া। নতুন পাতা গজানো। বড় হতে হতে একসময় কলি, ফুল ছোট্ট ছোট্ট মরিচ! আহ! মরিচ ধরে যখন খেত পরিপূর্ণ হয়, তখন মরিচের সুঘ্রাণ আসে নাকে। তখন ঠিক জীবনানন্দের কথা মনে পড়বে, ‘এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে।’ কবি এসব দেখেই পাগল হয়েছিলেন। মরিচে গাছ নুয়ে পড়লে রফিক চাচা হাতে ধরে ধরে আদর করেন।
ভোরবেলা কুয়াশা উপেক্ষা করে করলাখেতে ফুল লাগাতে যান। প্রতিটি ফুলের পাশে গিয়ে ফুলের মাথায় জরি লাগাতে হয়। কুয়াশায় ভিজে একাকার হয়ে যায়। তারপর আসেন মিষ্টিকুমড়ার মাঠে। সবুজ–শ্যামল মাঠে কুমড়ার ফুল ফুটে কাজী নজরুলের ‘ঝিঙে ফুল’ কবিতার মতো হলদে হয়ে যায় মাঠ। একটা একটা করে খুঁজে খুঁজে জরি লাগিয়ে কুমড়াকে খাওয়ার উপযোগী করে তোলেন। সেখানে আবার বিভিন্ন প্রাণীর ভয়। পাহাড়ি খেতে হাতি, বন্য শূকর ও সজারু ইত্যাদি খেতখামারে হানা দেয়। ফসল নষ্ট করে কৃষকের কপালে হাত দিতে বাধ্য করে। জীবন কঠিন!
বর্ষাকালে পানিতে টইটম্বুর সব। আপনি আমি বাসায় ঘুম। টিভির সামনে ব্যস্ত, নয়তো হাতে মুঠোফোন অথবা পরিকল্পনা করছি কী করা যায় এই পুকুরডুবা বর্ষায়! তখন রফিক চাচা ভাঙা ছাতা নিয়ে চলে যান পাহাড়ে! যেখানে মৃত্যুর গন্ধ ছড়ায়। পাহাড় ধসে পড়ে। বনের মস্ত বড় হাতি হাঁক ছাড়ে। বন্য কুকুর ও হিংস্র প্রাণীর ভয়! পানিতে ঝিরিপথ ও গিরিপথ নদীর মতো হয়ে গেছে। রাস্তা কোথায়, চেনার বিন্দুমাত্র উপায় নেই। সেই পানি পার হয়ে রফিক চাচা বাগানে পেয়ারা আনতে যান। গভীর জঙ্গলে বৃষ্টির পানি পড়ছে মাথায়, চোখে-মুখে। তবু রফিক চাচা থেমে নেই। গাছে উঠে পেয়ারা ছিঁড়েন, নির্দিষ্ট সময়ে ৭০ কেজি ওজনের বোঝা বহন করে বাজারে এনে বিক্রি করতে হবে। জসীমউদ্দীনের ‘রুপাই’ কবিতার কথা চিন্তা করুন!
রফিক চাচা আবার ধান উৎপাদন করেন। যে ধান থেকে চাল আসে। আমরা খাই। এই ধান সহজে চালে পরিণত হয় না। কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। কষ্টের পর কষ্ট করে যখন রফিক চাচা সকালে ধানের সবুজ গায়ে পরিষ্কার কুয়াশা দেখেন, মন অজান্তেই হেসে ওঠে। জড়িয়ে ধরে বুকে। নিশ্বাস নেয় বড় বড় করে। আসমানের দিকে চেয়ে থাকে। একসময় গাছে শিষ আসে। ধান হয়। তবে ভয় আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ‘সোনার তরী’ কবিতার কৃষকের মতো। কখন বৃষ্টি আসে। কখন বন্যা আসে। লালিত–পালিত করে তোলা ধানকে গ্রাস করে ফেলবে। বহু চিন্তা, হতাশা পেরিয়ে যখন ধান বাড়িতে আসে, তখন উঠান পরিপূর্ণ হয় ধানের স্তূপে। তারপর নতুন চালের পিঠা বানায়। গ্রামের সবাই মিলে খায়। আহা আনন্দ!
রফিক চাচা আবার তরমুজ ও বাঙ্গির চাষও করেন। তপ্ত রোদে পাহাড়ের ঢালে। পানি কাঁধে নিয়ে উঠতে হয়। প্রতিটি গাছের গোড়ায় পানি দিতে হয়। তীব্র রোদ। খাঁ খাঁ করছে পাহাড়। মানুষ এসি রুমে নিশ্বাস নিতে পারে না। সেই রোদে রফিক চাচা বারোজোনা (জায়গার নাম) পাহাড়ের উঁচুতে পানি তুলে তরমুজ-বাঙ্গি চাষ করেন। তরমুজ ধরার পরে কাটলে ভেতরে গরগরে লাল যখন দেখে, তখন সব আর্তনাদ, দুঃখ-কষ্ট গায়ের ঘাম চলে যায়। হাসি ফুটে তৃষ্ণাময় ঠোঁটে। খেতের তরমুজ খেয়ে তৃষ্ণা মেটায়। কেটে কেটে সবাইকে খাওয়ায়। শহর থেকে বড় বড় আড়তদার গিয়ে পুরো খেত কিনে ফেলেন। একত্রে টাকা পেলে সে কী উল্লাস! গরু কেনেন। মেয়ে বিয়ে দেন। ঘরবাড়ি ঠিক করেন।
রফিক চাচা মসলা চাষও করেন। আদা, হলুদ ও পেঁয়াজের চাষ। আপনি গভীর বর্ষায় আদাখেতের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে এক অদ্ভুত নেশায় হারিয়ে যাবেন। কী সুললিত ঘ্রাণ! চমৎকার অনুভূতি! আদাগাছে ফুল আসে। ফুল বিক্রি করে। আদা ও হলুদ মাটির নিচে পড়ে। এক ফালা তুলে হাতে নিলে দেখবেন আহসান হাবীবের কবিতা সেই ‘অস্ত্রের মতো’ তাকিয়ে আছে। তবে ভয়ের নয় আশার অস্ত্র! হা হা হা! কী প্রফুল্ল সূর্যমুখীর মতো আদা ও হলুদের ফালা। পেঁয়াজগাছের গন্ধে মাতোয়ারা! রফিক চাচা যেন ফসলের দার্শনিক! তিনি একাধারে সব ফসল তৈরি করতে পারেন। দেশের কাঁচাবাজারে অবদান রাখতে পারেন। মানুষের ক্ষুধা নিবারণ করেন।
এ ছাড়া রফিক চাচার জাতীয় ফল কাঁঠালের গাছ আছে। লিচু, আম, কুল, কলা, পেঁপে ও পেয়ারা বাগান আছে। সকালের সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠেন। নামাজ বাদ যায় না। সূর্যাস্ত পর্যন্ত সোনার দেশের সোনার মাঠে সোনার ফসল তুলে মানুষের জীবিকা মেটান। সহস্র কষ্ট, দুর্দশা, হতাশা, হাসি, কান্না, সুখ ও দুঃখ নিয়ে রফিক চাচার জীবন। কেউ কিছু চাইলে খালি হাতে ফেরত দেন না। মানুষ মরলে কবর খনন করতে ভুলেন না। জানাজায় উপস্থিত হতে ভুলেন না। নামাজে বসে প্রার্থনা করতে ভুলেন না। সনাতন বা ভিন্ন ধর্মের বন্ধু ও প্রতিবেশীর সঙ্গে নিদারুণ ভাব। মারা গেলে গোরস্তানের পাশে কাঁদেন। একে অপরকে ভালোবাসেন, সম্মান করেন। বিপদে-আপদে পাশে, কাছে ও সঙ্গে থাকেন। রফিক চাচারা বেঁচে থাকুক হাজার বছর।
শিক্ষার্থী, সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম