মৃত্যুর দোরগোড়া অবধি না গিয়েও একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের মনের অনুভূতি এত সাবলীল ও সূক্ষ্ম করে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ফুটিয়ে তোলা, নিজ মানস দিয়ে অপরের জীবন এত গভীরভাবে উপলব্ধি করা শুধু আহমদ ছফার দ্বারাই হয়তো সম্ভব। ‘মরণ বিলাস’ আহমদ ছফার একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। উপন্যাসটিতে যেভাবে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মৃত্যুশয্যার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা বেশ সূক্ষ্ম এবং তাতে বিভিন্ন মতবাদ, ঘটনা ও মনস্তত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে।
উপন্যাসের মূল ভূমিকায় ক্যানসার আক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফজলে ইলাহী। তাঁর শেষ শয্যায় বসে, কখনো দাঁড়িয়ে একজন পাতিনেতা ও রাষ্ট্রপতির সুদৃষ্টিতে আসতে ব্যাকুল মাওলা বক্স। ‘মরণ বিলাস’ উপন্যাসটি পুরোটাই মূলত মন্ত্রী ফজলে ইলাহী ও মাওলা বক্সের মধ্যে কথোপকথন।
শয্যাশায়ী মন্ত্রী চান তাঁর জীবনের যত গোপন অপকর্ম আছে, তা অন্তত পৃথিবীর একজন মানুষকে বলে যেতে পারলে নিজের জীবনকে আর বৃথা মনে হবে না। মন্ত্রী চান না তাঁর এত গোপন অপকর্মের বোঝা তিনি একা বয়ে নিয়ে যান পরপারে। মাওলা বক্সকে বলে যেতে চান সব গোপন পৈশাচিক কর্মকাণ্ড। তাঁদের কথোপকথনে, তর্কে-বিতর্কে, পারস্পরিক স্তুতি ও নিন্দায়, কখনো স্বগতোক্তিতে, কখনো সুস্পষ্ট উচ্চারণে, কখনো শালীন বাক্যে, কখনো খিস্তিতে, কখনো তীব্র ঘৃণায়, কিংবা কখনো বিনম্র শ্রদ্ধার অনুভূতিতে পেরিয়ে যায় হাসপাতালের শেষ রাতটি। আসে নতুন ভোর।
ক্ষণে ক্ষণে জ্ঞান হারানো মন্ত্রী যখনই সংবিৎ ফিরে পান, তখনই তাঁর মস্তিষ্কের অলিগলি ছাপিয়ে অতীত জীবনের সব স্মৃতি ভিড় করে আসে চোখের সামনে। সেসব স্মৃতি অসৎ কর্মের, পাপের স্মৃতি।
কাহিনির মূল নায়ক ফজলে ইলাহী একজন শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি দেশের ক্ষমতাসীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর ক্ষমতা এখনো বজায় আছে; কিন্তু কঠিন রোগের কারণে ভঙ্গুর জীবনের অনিশ্চয়তা তাঁকে সময়ের আগেই রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে। একজন মহাক্ষমতাবান মন্ত্রী মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছেন, কিন্তু তাঁর শয্যার পাশে একজন পেশাদার স্বার্থান্বেষী সেবক ব্যতীত কেউ নেই— সহকর্মী, তোষামোদকারী, নেতা, এমনকি পরিবার-পরিজন কেউ না। ক্ষণে ক্ষণে জ্ঞান হারানো মন্ত্রী যখনই সংবিৎ ফিরে পান, তখনই তাঁর মস্তিষ্কের অলিগলি ছাপিয়ে অতীত জীবনের সব স্মৃতি ভিড় করে আসে চোখের সামনে। সেসব স্মৃতি অসৎ কর্মের, পাপের স্মৃতি। যেসব পাপবোধ তাঁকে কোনো দিন স্পর্শ করতে পারেনি, কিংবা স্পর্শ করলেও গ্রাস করতে পারেনি।
মন্ত্রীর দুরবস্থা টের পেয়ে যখন সেবক মাওলা বক্স তাঁকে তওবা করানোর জন্য মাওলানা ডাকার অনুমতি চায়, তখনই ধমক খেয়ে থেমে যেতে হয়— ‘মাওলা বক্স, তুমি একটা আস্ত শুয়োরের বাচ্চা। মৃত্যুর সময় মাওলানা ডেকে আমাকে দুর্বল করে ফেলতে চাও! সেটি হচ্ছে না মাওলা বক্স, সেটি হচ্ছে না।’
সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চাওয়ারও মন্ত্রীর কোনো ইচ্ছা দেখা যায় না। পাপ স্বীকার করার চেয়ে তাঁর জন্য কঠিন কাজ ছিল পাপকে পাপ বলে গ্রহণ করা। যে পাপবোধের মুখ চেপে ধরে তিনি অন্তরের অন্দরে দাফন করে রেখেছিলেন সারাটি জীবন, জীবনের শেষ মুহূর্তে সেই পাপবোধ নিজের কফিন ভেঙে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। স্বীকারোক্তির চেয়ে তাই আত্মোপলব্ধি বেশি জরুরি।
জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে ফজলে ইলাহী চান একজন শ্রোতা, যে কোনো বাধা না দিয়ে শুধু তাঁর কৃতকর্মের ফিরিস্তি শুনে যাবে। দুঃসহ চেতনার ভারে আর মৃত্যুর পরের অজানা জীবনের অনিশ্চয়তায় পড়েই হয়তো দিশাহারা হয়ে ওঠেন মন্ত্রী ফজলে ইলাহী। সৎভাইকে হিংসার বসে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছিলেন। এরপর একসময় তিনি রেঙ্গুনপ্রবাসী চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন গভীর প্রণয়ে। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘকাল শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার পর অন্তঃসত্ত্বা হয়ে লোকলজ্জায় আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল সেই নারী।
স্কুলে পড়াকালীন অসৎ সঙ্গ পেয়ে জড়িয়ে পড়েন নানা অপকর্মে। ঘৃণার আগুনে জ্বালিয়ে দেন স্কুলের হিন্দু হেডমাস্টারের বসতবাড়ি; দগ্ধ করেন হেডমাস্টার ও তাঁর সব সহায়সম্বল। কীভাবে রাজনীতির সঙ্গে জুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে পরবর্তী সময়ে সাধু নেতা সাজেন, কীভাবে রাজনৈতিক সফলতা পান, সব ভয়ানক ঘৃণ্য পৈশাচিক কাজের পরও। কোনো অপকর্মের জন্য তিনি অনুতপ্ত নন! বরং দুষে যান জীবনের প্রেক্ষাপটকে, সমাজের পারিপার্শ্বিকতাকে।
ফজলে ইলাহী বলতে থাকেন, তিনি যে শুধু খারাপ কাজই করেছেন তা নয়, জীবনে একটা মহৎ কাজও করেছেন। এক কিশোরের জীবন ভিক্ষা দেন তিনি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় এক কিশোরকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। সেই মহৎ কাজ তাঁকে বারবার পাপবোধে গ্রাস হওয়া থেকে বাঁচাচ্ছে। যখন মৃত্যুশয্যায় জীবনের সব অপকর্মের পাপবোধ তাঁকে বাজেয়াপ্ত করতে চায়, তখন সেই কিশোর এসে বাঁচায়।
আহমদ ছফা অতি সন্তর্পণে কথোপকথনের ছলে কাহিনিপ্রবাহ এগিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু তিনি কখনোই পাঠককে বিচারকের আসনে বসাতে চাননি।
এদিকে তাঁর অপকর্মের কথা শুনে মাওলা বক্স নিজের মধ্যে যুদ্ধ করছিল। ভাবছিল, তাঁর সঙ্গেই কেন এসব হলো? কেন তাকেই এসব শুনতে হলো। সে ভাবতে পারছিল না মন্ত্রী মারা যাওয়ার পর তার জীবনে কী হবে। সে নিজেও অনেকটা মন্ত্রীর মতো চিন্তাভাবনা রাখা সত্ত্বেও মেনে নিতে পারছিল না মানবসন্তানের রূপে, এই রাক্ষস–বৃত্তান্ত! শেষনিশ্বাসের আগে মন্ত্রী তাকে বললেন, একটা আলো এসে গ্রাস করছে তাঁকে। তারপরই নিথর মন্ত্রীর দেহ।
স্বর্গ আর নরকের চিরন্তন সহাবস্থানে মানবজীবন ‘মরণ বিলাস’–এর মুখ্য উপজীব্য। ফজলে ইলাহী মূলত তাঁর জীবনের তিনটি বিশেষ ঘটনা বর্ণনা করেন মাওলা বক্সের কাছে। কাম, লালসা ও ঘৃণা। অবিবেচনার মোড়কে আবৃত এ ঘটনাগুলো যেন মানবজীবনের চিরন্তন কদর্যতারই প্রতীক। প্রতিটি পাপকেই ফজলে ইলাহী পাশ কাটিয়ে এসেছেন, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, জীবনে খ্যাতি ও প্রতিপত্তি অর্জন করেছেন, কিন্তু জীবনসায়াহ্নে এসে সব অর্জনের নিষ্ফলতা তাঁর সামনে প্রকট। আহমদ ছফা অতি সন্তর্পণে কথোপকথনের ছলে কাহিনিপ্রবাহ এগিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু তিনি কখনোই পাঠককে বিচারকের আসনে বসাতে চাননি। ফজলে ইলাহীর উক্তির মাধ্যমেই তিনি পাঠককে যেন একপ্রকার সাবধানই করে দিয়েছেন।
‘উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই, শুনে রাখো, মানুষ মানুষের কর্মের বিচারক হতে পারে না। তারপরেও তোমার মন যদি কৈফিয়ত দাবি করে বসে, অবশ্যই আমারও কিছু বলার থাকবে।’ লেখক পাঠককে তাঁর কাহিনি ও কাহিনির ভেতরের কাহিনির মধ্যে মেশাতে পেরেছেন। পাঠককে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, ভাবতে উৎসাহিত করেছেন, একই সঙ্গে অন্ধভাবে বিচার করতে বাধা দিয়েছেন।
মূল তিনটি গল্পের বা ঘটনার বাইরে আরও একটি ঘটনা ছিল ফজলে ইলাহীর জীবনে, যা তাঁকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত পাপবোধের মধ্যেও মুক্তির আলো দেখায়। পাহাড় সমান পাপ করার পরও কি একজন মানুষের পাপমুক্তির স্বপ্ন দেখা উচিত? ফজলে ইলাহীর ভাষায় আহমদ ছফা বলেছেন, ‘ওহে মাওলা বক্স, তোমার সমস্ত হিসাব মুদি দোকানদারের মতো। তুমি যে অত মানুষ হওয়ার গৌরব করছ, নিজেকে প্রশ্ন করে দেখো তুমিও কি মানুষ। মানুষের উচ্চতা, মানুষের গভীরতার কী জানো তুমি?’
‘মরণ বিলাস’-এর ছফা প্রচণ্ড আশাবাদী। মানুষ ও মানুষের জীবন নিয়ে তাঁর দৃপ্ত আশাবাদই মূলত ব্যক্ত হয়েছে এ বইটিতে। তিনি মানুষের প্রগতিতে ও চিরন্তন সম্ভাবনায় বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। যে ফজলে ইলাহী মাওলা বক্সকে কাহিনির শুরুর দিকে বলেন, ‘মাওলা বক্স, তুমি চাটুকার। তোমাকে ঘৃণা করতে ইচ্ছা হয়। তবু আমি তোমার তারিফ করি। তুমি ঠিক সময়ে ঠিক কথাটি বলে ফেলতে পারো। এটি তুচ্ছ জিনিস নয়।’ আবার শেষের দিকে আমরা শুনতে পাই, ‘মাওলা বক্স, তুমি নিষ্ঠুর এবং হৃদয়হীন মানুষ। তোমার নিষ্ঠুরতার সঙ্গে দুনিয়ার কোনো একনায়কের নিষ্ঠুরতার তুলনা হয় না। তুমি এমন একটি পদ্ধতি অনুসরণ করে যুক্তিজাল বিন্যাস করছ, যা আমাকে নিজের কাছে তুচ্ছ এবং অকিঞ্চিৎকর করে তুলেছে। তুমি আমার আমিত্বকে খণ্ড খণ্ড করে কেটে ফেলছ।’
একজন পাপিষ্ঠ মন্ত্রী নিজের পাপ রোমন্থনের ছলে যেন বহুকষ্টে লভিত জীবনবোধ তাঁর সেবকের ভেতরে ছড়িয়ে দিলেন। মন্ত্রী ও সেবক দুজনের জন্য সেই রাত শেষের ভোরটি অন্য রকম ভোর ছিল। একই সঙ্গে তিনি সাম্প্রদায়িকতা, পশ্চাৎপদতা, প্রভূত রিপু ও মানবীয় সীমাবদ্ধতাসমূহ অবজ্ঞা করে মানুষ হিসেবে আমাদের যে অপার সম্ভাবনা, তাকে জড়িয়ে ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। নিঃসন্দেহে ‘মরণ বিলাস’ আহমদ ছফার শ্রেষ্ঠতম কীর্তিগুলোর একটি। লেখক তাঁর সূক্ষ্ম জীবনবোধ ও মানবদর্শন প্রকাশ করেছেন ‘মরণ বিলাস’-এ।
পূর্ব নতুন পাড়া, সুনামগঞ্জ সদর