বিস্তীর্ণ এক জনপদ। মানববসতি সামান্য। এই সামান্যের মধ্যেই দেশের কৃষিজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখছে মফিজ মিয়ার পরিবার। নদীর কলতান, পাখপাখালির কলকাকলি তাদের নিত্যসঙ্গী। নদীভাঙনের বহু বছর পর এখানে জাগে নতুন চর, হয় বসতি। দুচোখ যেদিকে যায়, সেখানেই দেখা মেলে সবুজের সমারোহ। চোখে পড়ে তেজোময় লতাগুল্ম। এলাকাটি মিয়ার হাট নামে পরিচিত। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে প্রবহমান মেঘনার তীরে এই জনপদের অবস্থান। মেঘনার তীরে হলেও ছোট-বড় কয়েকটি নদী ঘিরে রেখেছে এ অঞ্চলকে। মফিজ মিয়া এখানকারই একজন কৃষক। চরে ফসল ফলান কয়েক একর জমিতে। মফিজ মিয়ার রয়েছে ২৮টি গরু, ৬টি ছাগল ও অর্ধশতাধিক হাঁস-মুরগি। এরাও তার পরিবারের অংশ—এমনটিই মনে করেন তাঁর স্ত্রী ফুলপরী বেগম।
রৌদ্রময় সকালে মফিজ মিয়া চললেন হাটের দিকে। এলাকায় বড় বাজার বলতে এক মিয়ার হাট বাজারই আছে। সলেমন মিয়া এই বাজারের বড় আড়তদার। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়াও বিক্রি করেন বিভিন্ন কৃষিজ উপকরণ। ফসলের জন্য কীটনাশক কিনতে সলেমন মিয়ার দোকানে যাচ্ছেন মফিজ। সলেমন মিয়া দোকানে নেই, কর্মচারী শফিকুলকে বলে বাকিতে নিলেন ধানের পোকা মারার কীটনাশক। ফিরতি পথে মফিজ মিয়া হাঁটছেন আর ভাবছেন, ‘এবারের ফলন ভালো অইলে হোলাগারে একটা নতুন সাইকেল কিনি দিয়াম।’ তাঁদের দুই সন্তান। ছেলে ফয়েজ ছোট আর মেয়ে মোবাশ্বেরা বড়। ফয়েজ মিয়ারহাট হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর থেকেই সে সাইকেলের বায়না ধরেছে। এক বছর হয়ে গেলেও মফিজ মিয়ার সাধ্য হয়ে ওঠেনি বায়না পূরণ করার। ফসলের দাম কম পাওয়ায় এমন অনেক স্বপ্নই পূরণ হয় না তাঁদের—এমন নানা কথা ভাবতে ভাবতে মফিজ মিয়া প্রবেশ করলেন বাড়ির আঙিনায়।
মোবাশ্বেরা বাবার পায়ের শব্দ শুনে ঘর থেকে বের হলো। হাতে কীটনাশকের পোঁটলা দেখে বলল, ‘আব্বা আঁর লাই কিছু আনেন নো? আন্নে তো কইছিলেন আঁরে একজোড়া নূপুর দিবেন।’ মফিজ মিয়া মেয়ের কথা শুনে বলল, ‘এবার ফলন ভালো অইলে তোমারে নূপুর, কানের দুল, এক্কান লাল টুকটুকে শাড়ি কিনি দিয়াম। অন আব্বার হাত খালি।’ ফুলপরী বেগম রান্নাঘরে লইট্যা মাছের দোপেঁয়াজি করতে করতে রাগমুখে বললেন, ‘আন্নের আর ভালা ফলন, হেই এক বছর আগের তন হোলাগা এক্কান সাইকেলের লাই মুচ্চা যায়, মাইয়্যা গা এক্কান নূপুরের লাই কয়দিন কইছে, আন্নে অনো যেই হেই। না দিতে হাইল্লে আশা দেন কিল্লাই!’ বৌয়ের রাগমুখো কথা শুনে মফিজ মিয়ার রাগ আসে না। তিনি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে। মনে মনে ভাবছেন, ফুলপরীকে আজ মানুষ কম, পরি বেশি লাগছে। ১৩ বছর বয়সে মফিজ মিয়ার সংসারে আসেন ফুলপরী বেগম। সেই সংসারে আলো নিয়ে আসে মেয়ে মোবাশ্বেরা। মোবাশ্বেরার বয়স ১৯ বছরে পড়বে আর কদিন বাদে। সে হিসাবে তাঁদের সংসার বছর কুড়ি ছুঁই ছুঁই। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় ফুলপরীকে এখনো যুবতী মনে হয়। মফিজ মিয়া এত বছর পর এটিই আবিষ্কার করলেন। স্বামীর অপলক তাকিয়ে থাকা দেখে ফুলপরী ধমকের সুরে বলল, ‘বুড়া বয়সে আইয়ো আন্নের ভীমরতি যায় নো!’ বাবার সঙ্গে মায়ের এমন খুনসুটি দেখে মোবাশ্বেরা হাসছে।
সকাল পেরিয়ে দুপুর, সূর্য এখন মাথার ওপর। তপ্ত রোদে মাঠে কাজ করছেন মফিজ মিয়া। সকালে পান্তা খেয়ে বেরিয়েছেন! ফয়েজের স্কুলে বিরতির সময় হয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যে সে-ও এসে পড়বে। ফুলপরী বেগম ডাকছেন, ‘মোবাশ্বেরার বাপ, ভাত খাই যান।’ সূর্য সামান্য হেলে পড়তেই ফয়েজ এল। আজ আর স্কুলে ক্লাস হবে না। মফিজ মিয়াও মাঠের কাজ রেখে ঘরে এলেন। মোবাশ্বেরা শীতলপাটি মেঝেতে বিছিয়ে দিল। ফুলপরী বেগম ভাত আর লইট্যা মাছের দোপেঁয়াজি নিয়ে এলেন। যথারীতি বাবা-ছেলের পাতে ভাত-মাছ দিয়ে খাওয়া শুরু করল পুরো পরিবার। এমন সময় বাড়ির চনের তৈরি প্রধান ফটক থেকে ডাক হাঁকলেন মতি ঘটক, ‘মফিজ মিয়া, ও মফিজ মিয়া।’ ভাতের প্লেট রেখে উঠে এলেন মফিজ মিয়া। চিনতে পেরে বললেন, ‘ঘটকসাব নাকি, কেমন আছেন?’ অনেকটা অপ্রস্তুত অবস্থায় ভাতের প্লেট হাতে এক দৌড়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল মোবাশ্বেরা। মাথায় কাপড় টেনে দিয়ে মতি ঘটককে সালাম দিলেন ফুলপরী বেগম। এই ঘটকের ব্যাপক পরিচিতি। কথা না বাড়িয়ে মতি ঘটক বললেন, ‘মফিজ ভাই, আন্নের তো ওগ্গা মাইয়া আছে। হুইনলাম ম্যাট্রিক পাস করি রায়রা মাদ্রাসায় ভর্তি অইছে! আঁর কাছে এক্কান ভালা সম্বন্ধ আছে। হোলা সৌদি আরব থায়ে, বিরাট হইসাআলা।’ ঘটকের কথা শুনে মফিজ মিয়া আগ্রহ প্রকাশ করে বলেন, ‘সবেই আল্লাহর ইচ্ছা। বিয়ার হুকুম অইলে আঁই ধরি রাহইন্না কে!’
স্বাভাবিক আলাপচারিতা সেরে বিদায় নিলেন মতি ঘটক। বিদায়ের মুহূর্তে শুক্রবার দিন ছেলেপক্ষ দেখতে আসার কথাও জানিয়ে দিলেন। শুক্রবার এল। সন্ধ্যে নামতে আর অল্প সময় বাকি। সলেমন মিয়ার দোকান থেকে মেহমানদের জন্য ট্যাং, বিস্কুট, চানাচুর আর ফল বিক্রেতা হারিছ খাঁর কাছ থেকে কিনলেন দুটি তরমুজ, সঙ্গে কবির হাজির কসমেটিক দোকান থেকে মেয়ের শখের একজোড়া নূপুর নিয়ে মফিজ মিয়া বাড়ি ফিরলেন।
মাগরিবের আজান হচ্ছে। ফুলপরী বেগম ঘর গোছাতে ব্যস্ত। মোবাশ্বেরা নামাজ পড়া শেষ করে সামান্য সেজে নিল। বাবার নিয়ে আসা নূপুর পরে তার বেশ ভালোই লাগছে। এর মধ্যে ফয়েজ এসে জানাল, পাত্রপক্ষের লোকেরা আসছেন। মফিজ মিয়া বাড়ির প্রধান ফটকে এসে সালাম বিনিময় করে তাঁদের ঘরে নিয়ে গেলেন। হাতভর্তি ফলফলাদি সঙ্গে আনলেন তাঁরা। সেগুলো ফয়েজকে দিয়ে ভেতরে পাঠানো হলো। ঘোমটা মুড়িয়ে মাথা নিচু করে মেহমানদের জন্য নাশতা নিয়ে এল মোবাশ্বেরা। অল্প আওয়াজে সবাইকে সালাম দিল সে। পাত্রের ছোট খালা হাসনা বেগম ঘোমটা উঁচিয়ে ধরে বলে উঠলেন, ‘মাশা আল্লাহ, মেয়ে তো খুব সুন্দরী।’ অবশ্য সুন্দরী হবে না কেন! মেয়ের মা-ও যে রূপে-গুণে কম নন!’ পাত্রের বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘মা, তোমার নাম কী?’ মোবাশ্বেরা মিষ্টি কণ্ঠে বলল, ‘জান্নাতুল মাওয়া মোবাশ্বেরা।’ পাত্রের বড় ভাই বলল, ‘বাহ্, বেশ সুন্দর নাম তো!’ সময়ক্ষেপণ না করে হাসনা বেগম মোবাশ্বেরার দুই কাঁধে আলতো করে ধরে বললেন, ‘দাঁড়িয়ে আছ কেন মা? এখানে বসো।’ শেষে কন্যার হাতে এক হাজার টাকার দুটি কচকচা নোট পুরে দিলেন ছেলের খালা। সেই সঙ্গে মেয়ের একটা ছবি মোবাইলে ধারণ করে বিদায় নিলেন তাঁরা।
রোববার সকাল সাড়ে আটটা। ফয়েজ স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। উনুনে বসে মাকে রুটি তৈরিতে সাহায্য করছে মোবাশ্বেরা। রুটি খেয়ে সে-ও মাদ্রাসায় যাবে। আজ সেখানে নারীর সামাজিক নিরাপত্তাবিষয়ক একটি সেমিনার রয়েছে। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে সে-ও বক্তৃতা করবে। এমন সময় পান চিবোতে চিবোতে এসে হাজির মতি ঘটক। ফুলপরী বেগমকে সুযোগ না দিয়ে বড় করে দিলেন এক সালাম। মোবাশ্বেরা এবারও এক দৌড়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল। ফুলপরী বেগম হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছেন ভাইসাব?’ ভালো খবর আছে বলে ভালো থাকার কথা এড়িয়ে গেলেন ঘটক। বললেন, ‘মফিজ ভাই কই, হেতেনরে দেহি না কা।’ উনি একটু মিয়ার হাট গেছেন। মতি ঘটক বললেন, ‘ভাবিসাব, আন্নের মাইয়্যারে পাত্র আর তার পরিবার খুব হছন্দ কইচ্ছে। হেতারা আইজ বিয়ালে আইব।’ ঘরের ভেতর থেকে ঘটকের কথা শুনে মুচকি হাসছে মোবাশ্বেরা। ফুলপরী বেগম বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’
মোবাশ্বেরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। ছেলেটা মৃদু কাশি হেঁকে বলল, ‘কেমন আছেন?’ ‘জি ভালো, আপনি?’ ছেলেটা উদাস মনে কী যেন ভাবছে। খানিক থেমে মোবাশ্বেরা বলল, ‘কী নাম আপনার, কী ভাবছেন?’ ‘আমি আশরাফুজ্জামান অপু, জি ভালো আছি। ভাবছি, একটা মানুষ এত সুন্দর হয় কী করে!’ লজ্জায় মেয়ের দুই গাল লাল হয়ে গেল। প্রত্যুত্তরে সে কিছুই বলল না। একটু-আধটু করে বলা কথায় দুজনের জানাশোনা হলো। অপু জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছে!’ মুচকি হাসির ঝলক দেখিয়ে মোবাশ্বেরা বলল, ‘জানি না।’ অপুর বুঝতে আর বাকি রইল না।
দুপুর পেরিয়ে বিকেল গড়াল। মাদ্রাসা-স্কুল থেকে বাড়ি ফিরল দুই ভাই-বোন। মফিজ মিয়াও বাড়ি এলেন। মিনিট দশেক পর ঘরের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ! পাত্রপক্ষ হাজির। সর্বোচ্চ ভদ্রতারসহিত তাঁদের বসার ব্যবস্থা করে দিলেন মফিজ মিয়া। বিনিময় করলেন কুশলাদি। এর মধ্যে পাত্রের খালা মোবাশ্বেরাকে তৈরি করে নিয়ে এলেন। পাত্রের মা নেই। দুই ভাই আর এক বোনের মধ্যে পাত্র সবার ছোট। উপস্থিত সবার সম্মতিক্রমে পাত্র ও পাত্রীকে আলাদা কথা বলার ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো।
বাড়ির সীমানা থেকে বিস্তীর্ণ মাঠের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পাত্র। মোবাশ্বেরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। ছেলেটা মৃদু কাশি হেঁকে বলল, ‘কেমন আছেন?’ ‘জি ভালো, আপনি?’ ছেলেটা উদাস মনে কী যেন ভাবছে। খানিক থেমে মোবাশ্বেরা বলল, ‘কী নাম আপনার, কী ভাবছেন?’ ‘আমি আশরাফুজ্জামান অপু, জি ভালো আছি। ভাবছি, একটা মানুষ এত সুন্দর হয় কী করে!’ লজ্জায় মেয়ের দুই গাল লাল হয়ে গেল। প্রত্যুত্তরে সে কিছুই বলল না। একটু-আধটু করে বলা কথায় দুজনের জানাশোনা হলো। অপু জিজ্ঞেস করল, ‘আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছে!’ মুচকি হাসির ঝলক দেখিয়ে মোবাশ্বেরা বলল, ‘জানি না।’ অপুর বুঝতে আর বাকি রইল না। দুজনে মাথা নিচু করে ঘরে প্রবেশ করল। কথা বাড়াল দুই পক্ষ। বিয়ের জন্য শুক্রবার দিন ধার্য হলো।
মিয়ার হাটের সলেমন মিয়ার দোকান থেকে মুদিপণ্য আর মেঘনাপাড়ের বড় বাজার থেকে বাকি সব সামগ্রী কেনার কাজ বুধবারের মধ্যেই সারলেন মফিজ মিয়া। কিছু জমি বিক্রির উদ্দেশ্যে বায়না করা অর্থ দিয়ে কেনা হলো গয়না। বড় বাজারের বজল বাবুর্চিকে দেওয়া হলো রান্নার দায়িত্ব। এর মধ্যে এসে পড়লেন আত্মীয়স্বজন। যথারীতি শুক্রবার দিন নৌকাযোগে হাজির বরযাত্রী। সম্পন্ন হলো বিয়ের কাজ। বিয়ের পর আশরাফুজ্জামান অপু আর বিদেশ গেলেন না। নিজ বাড়িতে গড়ে তুললেন গরুর খামার। মোবাশ্বেরার পড়াশোনাও বন্ধ হয়নি। এরই মধ্যে আলিম পাস করেছে সে। তেজোময় লতাগুল্মের মতো বেড়ে উঠছে মোবাশ্বেরার স্বপ্ন।