মেলার সঙ্গে জীবন মেলানোর প্রাণবন্ত চলচ্চিত্রায়ন ‘কিত্তনখোলা’

‘কিত্তনখোলা’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যছবি: সংগৃহীত
নাটকের সঙ্গে চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্রের মধ্যে যাত্রা, যাত্রার মধ্যে গান, গানের সঙ্গে নাচ, চিত্রনাট্যে জীবনের ছবি আঁকা, ক্যামেরার ভাষায় কবিতা লিখা, শিল্পের প্রতিটি সত্তাও মিলেমিশে এক হয়ে আসে কিত্তনখোলাতে।

নাট্যজগতের আচার্য সেলিম আল দীনের কালজয়ী নাটক ‘কিত্তনখোলা’। সেই নাটককে চলচ্চিত্রায়িত করেছেন বাংলাদেশের গুণী পরিচালক আবু সাইয়ীদ। গুণী স্রষ্টার সৃষ্টিকে অন্য গুণী স্রষ্টা ভিন্ন মাধ্যমে নতুন রূপ দিতে এলে আলোর গতি যেমন প্রসারিত হয়, আলোর সঙ্গে আলোর মিলনে নবদিগন্ত উন্মোচিত হয়। বলাই বাহুল্য, আলোর ষোলোকলা পূর্ণ হয়ে স্বর্ণালি ইতিহাস এভাবেই নির্মিত হয়ে সফল ইতিহাসের ধারাবাহিকতা এভাবে রক্ষিত করে। এখানে বঙ্গ ভান্ডারের অমূল্য রতন বাংলা ভাষার সোনালি ফসল রূপালি পর্দায় এসে বহুমুখী কিরণ ছড়িয়েছে।

চলচ্চিত্রজুড়ে আছে মেলা, যাত্রাপালা, যাত্রাপালার কুশীলব এবং অসংখ্য জীবন চিত্রনাট্যের কুশীলবদের গল্প। এই কুশীলবরা প্রায় সবাই নিম্নমধ্যবিত্ত প্রান্তিক সমাজের। ফলে জীবন পোড়া, জীবন বিধ্বস্ত শিল্পীদের সংখ্যা এখানে বেশি। কেউ কেউ বিদ্রোহী হয়ে ফুলকি ছড়াতে চায়। ক্ষমতাশালী প্রতাপবানদের সঙ্গে পেরে না উঠে ধপ করে জ্বলে উঠে নিভে যায়। সেই প্রতাপবানদের চরিত্র তুলে না এনেও ছোট ছোট মানুষের এই গল্পগুলোকে দাঁড় করানো যায় না। তাই সেই ধনবান শ্রেণির চরিত্রের প্রতিনিধিও উঠে আসে।

সেই চরিত্রগুলোকে বিশ্লেষণ করতে গিয়েও আবার দেখা যায়, একসময় তাদের মধ্যেও কেউ কেউ প্রান্তিক শ্রেণি থেকে উঠে এসে বর্তমানে বিত্তবান ভোগবাদী হয়ে উঠেছে। আবার কেউ এককালে স্বচ্ছল শ্রেণির হলেও বর্তমানে প্রায় সব হারিয়ে সর্বহারার দলে এসে মিশেছে। মানুষের শ্রেণিবিত্ত বদল, জীবনবদল, জীবনের সঙ্গে জীবনের অনিবার্য সংঘাত, বিত্তের সঙ্গে বিত্তের লড়াই—সব মিলিয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর যে মানব জীবনের মেলা। তাকেই মেলে ধরে বাস্তবের গ্রামবাংলার বহমান একটি নদীর নামের রূপক।

নদী যেমন মোহনায় এসে মেশে, মেলার মধ্যে এসে মেশে অসংখ্য মানুষ। প্রতিটি মানুষই নিজের জীবনে এক একজন করে শিল্পী, প্রতিজন শিল্পীর জীবন নিয়ে যে বৃহত্তর শৈল্পিক কর্মশালা, শিল্পমণ্ডিত কর্মযজ্ঞ, জীবন-মরণের সীমানা ছাড়িয়ে সেই কর্মযজ্ঞের প্রতিটি মুহূর্তের লড়াই শিকড় ছড়িয়ে, শিকড়ের সঙ্গে শিকড় জড়িয়ে লড়তে লড়তে মরে, মরতে মরতে বাঁচে, বাঁচতে বাঁচতে শিল্পের দর্পণে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। ‘কিত্তনখোলা’ তাই হয়ে ওঠে যাত্রার রূপকের ভেতরে-বাইরে মিলিয়ে একটা বৃহত্তর চলমান যাত্রাপালা। নাটকের সঙ্গে চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্রের মধ্যে যাত্রা, যাত্রার মধ্যে গান, গানের সঙ্গে নাচ, চিত্রনাট্যে জীবনের ছবি আঁকা, ক্যামেরার ভাষায় কবিতা লিখা, শিল্পের প্রতিটি সত্তাও মিলেমিশে এক হয়ে আসে কিত্তনখোলাতে। জীবনটা সীমার মধ্যে অসীমের, অন্তের মধ্যেও নিরন্তর যাত্রার একটা পাগলা ঘোড়া। চলচ্চিত্রের শুরু থেকে শেষজুড়ে, ঘুরেফিরে আসে তাই একটি অসাধারণ রূপকধর্মী গান ‘আমার পাগলা ঘোড়া রে, কই মানুষ কই লইয়া যাও...।’

কিত্তনখোলা নদীর তীরে মাত্র তিন দিনের মেলা। মানুষের জীবনটাও যেমন গণ্ডীর সীমিত পরিসরে আয়ুর নিগড়ে বাঁধা-ধরা ভাঙা-গড়ার খেলা। গ্রামের সেই মেলাতে আউলবাউল, যাত্রাদলের লোক আসছে, তখনো এই গান বেজে চলেছে। যাত্রাদলের প্রধান নারী কুশীলব জীবনের কাছে হেরে গিয়ে তাঁবুর ভেতরে নিজের একলা কুঠুরিতে বিষপান করে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে— তখনো বাইরে পালার আসরে এই গান গেয়ে চলেছে অন্য কুশীলব। যাত্রাদলের পরাহত এই নারী কুশীলবের নাম ছিল বনশ্রীবালা।

নটী বিনোদিনী যেভাবে বারবণিতার পরিবেশ থেকে বাংলা নাট্যমঞ্চে উঠে এসেছিলেন, কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যেভাবে পতিতাপাল্লির এক নারীর কাছে অনেক কবিতার খাতা খুঁজে পেয়েছিলেন; বনশ্রীবালাও জীবনপোড়া একজন শিল্পী যাত্রামঞ্চে উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু যাত্রাদলের পেশাদারী পরিচালক যাত্রা ব্যবসায়ী, শিল্পী পোশাকের আড়ালে বনশ্রীর শরীর নিয়েও ব্যবসা করতে চায়। এই মেলাতে তাঁবু পড়ার আগেও বনশ্রীকে প্রতাপশালী দুজনের ঘরে ঢুকতে বাধ্য করেছে সুবল। এই মেলার প্রধান আয়োজক ইদু কন্ট্রাক্টরও নাচের পোশাকে বনশ্রীর নাচ দেখতে চায়। একলা ঘরে তাকে কাছে পেতে চায়। যাত্রাদলের প্রধান নায়ক কুশীলব রবি দাস সুবলের এই কাজকর্মের তীব্র প্রতিবাদ করে। বনশ্রীর অপমানে যাত্রা পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয়। কিন্তু সুবলের সঙ্গে পেরে ওঠে না। রবি বনশ্রীকে ভালোবাসে। যাত্রাদলের অন্য তরুণ কুশীলব ছায়ারঞ্জনও বনশ্রীকে ভালোবাসে। ছায়ার সঙ্গে এই প্রণয়ের বাঁধন অনেক স্নেহের, মায়ার বাঁধন। কিন্তু সব বাঁধন ছিন্ন করে বনশ্রীকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়।

শীতের মেলার ঘাটে কত জীবনতরী এসে ভিড় করে। জীবনতরীতে পসরা সাজিয়ে আসে কত রং-বেরঙের মানুষ। মেলার আসরে যাত্রার তাঁবুর পাশে বায়োস্কোপ দেখায় কেউ। মাটির পুতুল, পুতুল নাচ, ডালিমন নামের চুড়িওয়ালী, বেলুনওয়ালা, মুখোশ বিক্রেতা, খেলনার দোকান, ঘর সাজানো এবং রূপচর্চা-সাজগোজ প্রসাধনসামগ্রীর দোকান আরও কত যে পসরা সাজিয়ে বসেছে কতজন।

ছায়ারঞ্জন মুখোশ পরে এসে যাত্রার তাঁবুতে ঢোকে। মুখোশ খুলে রেখে মাটির ঘটিতে তরল পান করে। আবহ সুর সঙ্গতে মুখ আর মুখোশের এ দৃশ্য বড় চমৎকার। নৈশ আসরে বাউল গান ধরে, ‘গুরু রে যাব আমি শান্তিপুরে...’, ছায়া নেচে যায়। ছায়া যেন একই শরীরে কিছুটা নারী গোছের, স্বভাবগত মেয়েলি পুরুষ, শারীরিক গঠনগত দিকে একেবারে অর্ধনারীশ্বর অবশ্য নয়। জাত-ধর্মের গোড়ায় কুঠারাঘাত করে তার মন কখনো মুসলমান হতে চায়। জগৎসংসারের নাড়ির সম্পর্কের বন্ধনমুক্ত, সে এতিম। আর এতিম বলেই সুবল তাকে যাত্রামঞ্চে নিয়ে এসেও নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে। ছায়া সব দিক থেকেই তাই সুবলের খাঁচায় বন্দী থেকেও একপ্রকার স্বাধীনতার ছায়া। তার স্বাধীনচেতা মন নাচতে নাচতে বলে ওঠে, ‘সুন্দর বান্দর বুঝি না, নাচতে ভালো লাগল তা–ই নাচলাম।’ গানের আসরে বাউলকে সে জিজ্ঞেস করে, ‘গান আর নাচের মধ্যে তফাৎ কী?’ বাউল প্রথমে এড়িয়ে যায়। পরে বলে, ‘সুন্দরে সুন্দরে তফাৎ নাই। ভেদটা সুন্দরে আর বান্দরে।’

মঞ্চের দ্বন্দ্ব–সংঘাত, মঞ্চের মানুষের নিজেদের জীবনের দ্বন্দ্ব–সংঘাত, বাস্তবের সমাজ জীবনের চরিত্রদের জীবনের দ্বন্দ্ব–সংঘাত—সব মিলিয়েই যাত্রাপালা, মানুষের মিলনমেলা জমে ওঠে। পালার আসরে খোল, করতাল জুরি মৃদঙ্গ, ম্যান্ডলিন, ক্লাইনেট, নানা রকমের বাঁশি, কত রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজে। যন্ত্রসংগীতে ছিলেন সমীর দাস, নীতি রঞ্জন বিশ্বাস, দৌলতুর রহমান, মফিজুল ইসলাম, আব্দুল খালেক মিঞাসহ আরও অনেকে। যাত্রাপালা এবং ব্যবহৃত গানগুলো সব গ্রামবাংলার প্রচলিত। স্বয়ং পরিচালকের সুর পরিচালনায় কণ্ঠ সংগীতে ছিলেন দিপালী রাণী, পাগলা বাবুল, বাদল শহীদ, ইয়ারন মনিসহ আরও অনেকে।

গোটা চলচ্চিত্রের বাস্তবের কুশীলবরা হলেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, মামুনুর রশীদ, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, লায়লা আসাদ নূপুর, তমালিকা কর্মকার, আজাদ আবুল কালাম, কামাল আহমেদ, রহমত আলী, হাবিবুর রহমান হাবীব, আব্দুল হান্নান শেলী, তৌফিক হাসান ময়না, নাজনীন নাজ, সাথী, প্রদ্যুৎ কুমার স্বপন, বাবুল শরীফ, আব্দুর রশিদ বিশ্বাস, বিজয় শীল, পাগলা বাবলু, বাদল শহীদ, মাসুদ রানা মিঠু, সুলতান মাহমুদ, জাহিদুল ইসলাম, রতন মফিজুল ইসলাম, আব্দুল খালেক মিঞা, ইব্রাহীম, জানু মিয়া, সাইদুর রহমান, দিপালী রানী সরকার, ঝর্ণা রানী,  মনি দাস, রানী দাস, ইসলাম উদ্দিন পালাকার ও তাঁর সঙ্গীরা।

বগুড়া জেলার ভান্ডারী বাড়ি ইউনিয়নের যমুনার তীরে ষড়াবাড়ী ঘাটে এই মেলার আসর চিত্রায়িত হয়েছে। স্থিরচিত্র টুকু খন্দকারের। শিল্প নির্দেশনায় ছিলেন তরুণ ঘোষ। চিত্রগ্রহণ করেছেন সমীরণ ও অপু রোজারিও। ক্যামেরা সরবরাহ করেছে বাংলাদেশ শর্টফিল্ম ফোরাম। সম্পাদনা করেছেন সুজন মাহমুদ। কিছু কিছু সংলাপ সেলিম আল দীনের নাটক থেকে সরাসরি নেওয়া আর কিছু বুনেছেন পরিচালক নিজে। চিত্রনাট্য সাজিয়েছেন পরিচালক আবু সাইয়ীদ ও নূরুল আলম আতিক।

কালের বিবর্তনে আধুনিক অন্য মাধ্যমের প্রচারে ও প্রসারে গ্রামবাংলার যাত্রাপালাও হয়তো একদিন আমাদের বাস্তবের সমাজজীবন থেকে হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে বা আকারে ছোট হয়ে আসবে গ্রামবাংলার অনেক ঐতিহ্যবাহী পুরোনো মেলা। কিন্তু ‘কিত্তনখোলা’র পট আর প্রেক্ষাপট যা ইতিহাস হয়ে রয়েছে, তা কখনো হারাবে না।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত