কয়েক দিন ধরে পৃথার মন ভালো নেই। ভালো থাকবেই-বা কেমন করে। ওদের সবচেয়ে প্রিয় বিজ্ঞান শিক্ষক হঠাৎ করে গায়েব হয়ে গেছেন। স্যারের গায়েব হওয়ার বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারছে না। যে স্যারই আসেন, অমনি ওরা জিজ্ঞেস করে বসে, ‘স্যার, আমাদের বাবলু স্যার কোথায়? আমরা বাবলু স্যারের ক্লাস করব।’ ক্লাস নিতে আসা শিক্ষক ওদের ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন। জুম্মান স্যার তো বলেই ফেললেন, ‘কোন স্যার এল-গেল সেটা তোমাদের দেখার বিষয় না। আগে মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করো। যত্তসব!’
এভাবে পাঁচ দিন কেটে গেল। এ কয়েক দিনে বিজ্ঞান ক্লাসের অবস্থা যাচ্ছেতাই। বাবলু স্যারের মতো করে কেউ বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি বোঝান না।
মঙ্গলবার, পৃথার হঠাৎ মনে পড়ে ওদের বিজ্ঞান প্রজেক্টের কথা। বাবলু স্যার শেষ ক্লাসে ওদের একটি প্রজেক্ট কাজ দিয়েছিলেন। আসছে বৃহস্পতিবার ক্লাসে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর একটি করে উদ্ভিদ নিয়ে আসার কথা। স্যার জোর গলায় স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘উদ্ভিদ আনার ক্ষেত্রে কারোটার সঙ্গে কারোটার কোনো মিল থাকতে পারবে না।’
স্কুল ছুটির পর পৃথা সোজা বাসায় ফিরে আসে। হাত–মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে আসে। মা আগে থেকে মেয়ের জন্য খাবার রেডি করে বসে আছেন। হঠাৎ দূর থেকে ওকে লক্ষ্য করে বললেন,
: কী রে মামণি, তোকে এমন বিষণ্ন দেখাচ্ছে কেন? আজ কারও সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে?
: না মা, কিছু হয়নি।
: তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে।
: না মা, আমার কিছু হয়নি। তুমি শুধু শুধু টেনশন করছ। তবে আমি একটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত।
: কী সেই বিষয়?
: গত পাঁচ দিন ধরে আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষক বাবলু স্যার স্কুলে আসছেন না। কেন, তা–ও কেউ বলতে পারছে না। স্যারের মতো করে কেউ আমাদের সায়েন্স বোঝান না। এ নিয়ে ক্লাসের সবার মন খারাপ।
: ও আচ্ছা, এই কথা! এ নিয়ে চিন্তা করার কী আছে। তোমাদের স্যার হয়তো কোনো কাজে স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছেন। সময় হলে নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন।
: না মা, তাই যদি হতো স্যারের গায়েব হওয়ার বিষয়ে অন্যান্য স্যাররা তো আমাদের কিছু বলতে পারতেন।
: তোমাদের এত বেশি আগ্রহের কারণে হয়তো স্যাররা কিছু বলছেন না। থাক, এসব নিয়ে চিন্তা না করে আগে ভাত খেয়ে নাও। কথা বলতে বলতে অনেক সময় হয়ে গেছে।
: জি, মা।
পৃথা চোখ কপালে তুলে বলল, ‘ভিন্ন গ্রহের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শিখে কী লাভ, স্যার?’
‘লাভ আছে। ওরাও তোমাদের মতো জ্ঞানপিপাসু। এই পৃথিবী সম্পর্কে ওরা আরও জানতে চায়। আগামীর পৃথিবী ওরা ওদের করতে চায়।
এই কথা বলে পৃথা দুপুরের খাবার খেতে লাগল। খাওয়া শেষ করে সে বিজ্ঞান বইটা হাতে নিয়ে নিজের বেডরুমের দিকে চলে এল। কিছুক্ষণ বইয়ে চোখ বোলাতে বোলাতে দুই চোখে গভীর ঘুম নেমে আসে। মুহূর্তে সে নিজেকে একটি দূর পাহাড়ের ঢালে আবিষ্কার করে। আশপাশে তাকিয়ে দেখে, ও একা নয়; সঙ্গে সহপাঠী নিশি, ফিহা, রূপমিতাও আছে। সবাই বিজ্ঞান প্রজেক্টের উদ্ভিদ সংগ্রহের জন্য এখানে এসেছে। দুপুর থেকে হাঁটতে হাঁটতে ওরা খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে। একটানা হেঁটে হেঁটে পাহাড়ের একেবারে শীর্ষের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। এরই মধ্যে নিশি, রূপমিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই তোরা সবাই এবার একটু থামবি? আমার খুব খিদে পেয়েছে। দুপুর থেকে একটানা হাঁটছি।’
রূপমিতা ক্লান্ত হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ রে, আমারও খুব খিদে পেয়েছে।’ পাশ থেকে ফিহা বলল, ‘আমারও।’
পৃথাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফিহা আবার বলল, ‘কিরে পৃথা, তুই যে কিছু বলছিস না। তোর কি খিদে লাগেনি?’
পৃথা স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে জবাব দিল, ‘না, আমি ঠিক আছি। তোদের এত বেশি খিদে লাগলে এখন কী করবি? এখানে তো কোনো দোকানপাট পাবি না। আশপাশে ঘুরে ঘুরে দেখ খাওয়ার মতো কোনো ফল পাওয়া যায় কি না।’
রূপমিতা বলল, ‘আর তুই কী করবি?’
পৃথা বলল, ‘আমি এদিকটায় ঘুরে ঘুরে দেখি কাঙ্ক্ষিত উদ্ভিদ খুঁজে পাই কি না।’
‘আচ্ছা’ বলে রূপমিতা, নিশি ও ফিহা খাদ্যের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল। পৃথা একাকী পাহাড়ের আরও শীর্ষদেশে যেতে লাগল। হঠাৎ দরজায় ঘণ্টা বাজার মতো একটা আওয়াজ কানে ভেসে আসে। সে ভয়ে দাঁড়িয়ে যায়। মনে মনে ভাবতে থাকে, ‘এই নির্জন পাহাড়ে দরজায় ঘণ্টা বাজার আওয়াজ কী করে আসতে পারে। তবে কি এখানে আমরা ছাড়াও অন্য কেউ আছে!’
মুহূর্তে চোখের সামনে পাহাড়ের দুদিকে ফাঁকা হয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে পৃথা স্তব্ধ হয়ে যায়। মনে হলো পাহাড়ের ভেতরে একটি সুড়ঙ্গ আছে। মূল ফটক আপনাআপনি খুলে গেছে। এক পা-দুই পা করে সে সুড়ঙ্গের খুব কাছাকাছি চলে আসে। কৌতূহলী হয়ে ভেতরের দিকে তাকিয়ে দেখে খুব অন্ধকার। বাইরে থেকে মনে হচ্ছে ওদের বাবলু স্যারের গলার মতো কেউ একজন বিজ্ঞান ক্লাস নিচ্ছেন। একমুহূর্তে পৃথার মনে আশার সঞ্চার হয়। সে খুব মনোযোগী হয়ে ক্লাস শুনতে থাকে। এরপর আনমনে বিড়বিড় করতে করতে বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিকই তো! আমাদের বাবলু স্যারই ক্লাস নিচ্ছেন। কিন্তু এমন নির্জন অন্ধকার পাহাড়ের সুড়ঙ্গের ভেতরে স্যার কাদের ক্লাস নিচ্ছেন! নাকি আমি কোনো গোলক ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছি! ধুর! কিছুই মাথায় আসছে না।’
হঠাৎ সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে থেমে থেমে একটা আওয়াজ এল, ‘পৃথা, এমন আঁধারের মধ্যে ওখানে একাকী দাঁড়িয়ে কী ভাবছ?’
এবার পৃথা ভালোভাবে সুড়ঙ্গের ভেতরে লক্ষ করল। হঠাৎ দেখতে পেল সুড়ঙ্গের এক কোণে বাতি জ্বলছে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন বিজ্ঞান শিক্ষক। মুহূর্তে মন থেকে সব ভয় উধাও হয়ে গেল। স্যারকে উদ্দেশ করে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম, স্যার।’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম, তুমি এখানে কীভাবে এলে? আর কেউ আছে?’
‘জি, স্যার। আমার সঙ্গে নিশি, ফিহা ও রূপমিতা আছে। আমরা এসেছি আপনার দেওয়া প্রজেক্টের জন্য উদ্ভিদ সংগ্রহ করতে।’
‘তোমাদের কাঙ্ক্ষিত উদ্ভিদ পেয়েছ?’
‘না স্যার, এখনো পাইনি। আমরা খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে এসেছি।’
‘চিন্তা কোরো না। তোমরা ঠিক জায়গায় চলে এসেছ। এই সুড়ঙ্গের ডান দিকে কিছুদূর গেলে নানান বৈচিত্র্যের উদ্ভিদ পাবে। নিজেদের পছন্দমতো সংগ্রহ করতে পারবে।’
‘ধন্যবাদ, স্যার। কিন্তু আমাদের দুঃখ হচ্ছে আপনাকে নিয়ে। আজ এত দিন হয়ে গেছে আমরা আপনার কোনো ক্লাস পাচ্ছি না। এ নিয়ে সবার মন খারাপ।’
বাবলু স্যার মৃদু হেসে বললেন, ‘কেন? তোমাদের ক্লাসে আমার পরিবর্তে অন্য শিক্ষক আসেননি?’
‘এসেছেন। কিন্তু আমরা বিজ্ঞানের মজা হারিয়ে ফেলতে বসেছি। স্যার, আপনি আমাদের ছেড়ে এমন নির্জন পাহাড়ের সুড়ঙ্গের মধ্যে কেন পড়ে আছেন? প্লিজ স্যার, আবার ক্লাসে ফিরে আসুন।’
এবার বাবলু স্যার গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘শোন মা, আমি একটি বিশেষ কাজে এখানে এসেছি। এখানে তোমাদের মতো আরও কিছু শিক্ষার্থী আছে। অবশ্য ওরা তোমাদের মতো নয়। ভিন্ন গ্রহের। ওদের বিজ্ঞান ক্লাস নিচ্ছিলাম। তোমরা কোনো চিন্তা কোরো না। আগামী বৃহস্পতিবার তোমাদের ক্লাসে ব্যতিক্রম কিছু দেখতে পাবে।’
পৃথা চোখ কপালে তুলে বলল, ‘ভিন্ন গ্রহের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শিখে কী লাভ, স্যার?’
‘লাভ আছে। ওরাও তোমাদের মতো জ্ঞানপিপাসু। এই পৃথিবী সম্পর্কে ওরা আরও জানতে চায়। আগামীর পৃথিবী ওরা ওদের করতে চায়। মনে রেখো, কারও এগিয়ে যাওয়া বা পিছিয়ে পড়া নির্ভর করে তাদের শিক্ষাদীক্ষার ওপর। নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে তোমাদের আরও বেশি মনোযোগী হয়ে পড়াশোনা করতে হবে। ক্লাসে গিয়ে ওদের ব্যাপারে বিস্তারিত বলব। এখন আর কথা বাড়িও না। সন্ধ্যা নেমে গেছে। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। আর নিশি, ফিহা আর রূপমিতাও মনে হয় এদিকে আসছে। ওদের নিয়ে সাবধানে বাসায় ফিরে যাও। আরেকটা কথা, আমি যে এখানে আছি, এ কথা কাউকে বলবে না। এমনকি রূপমিতাদেরও না। বললে তোমাদের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে, বুঝলে?’
পৃথা মাথা নেড়ে বলল, ‘জি স্যার, আর কাউকে বলব না। আমরা আপনার অপেক্ষায় থাকব।’
বাবলু স্যার আবার হাসলেন। এরপর পৃথার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘গন্তব্যে ফিরে যাও। বৃহস্পতিবার তোমাদের ক্লাসে আমি আসব। তোমরা সবাই নিজ নিজ উদ্ভিদ নিয়ে হাজির হবে।’
এ কথা বলতে না বলতেই সুড়ঙ্গের মুখ আবার বন্ধ হয়ে গেল। ভয়ে ‘নিশি, ফিহা, রূপমিতা’ বলে পৃথা চিৎকার করতে লাগল। চিৎকার শুনে ওর মা পাশের কক্ষ থেকে দৌড়ে আসেন। ততক্ষণে পৃথা মেঝেতে গড়াগড়ি করে বলতে লাগল, ‘নিশি, আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষক এখানে আছেন। ফিহা, স্যার এখানে ভিন্ন গ্রহের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ক্লাস নিচ্ছেন। রূপমিতা, আসছে বৃহস্পতিবার স্যার আমাদের ক্লাসে উপস্থিত থাকবেন।’
সহকারী প্রধান শিক্ষক, জেলা প্রশাসন স্কুল অ্যান্ড কলেজ নোয়াখালী