প্রেরণার বন্ধুসভা

লেখকছবি: সংগৃহীত

২০০১ সালে ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে ভর্তি হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই প্রথম আলো বন্ধুসভার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। একবার শীতবস্ত্র বিতরণের সময় প্রকৃত গরিব ও অসহায় মানুষের তালিকা করার দায়িত্ব পড়ল বন্ধু আজহারুল (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক) ও আমার ওপর। এখনো মনে আছে, আমি আর আজহারুল মাঘ মাসের প্রচণ্ড শীতের মধ্যে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামে ঘুরে একটি তালিকা তৈরি করেছিলাম। তখনই বন্ধুসভার নেশাটা মাথার মধ্যে চেপে বসেছিল। এরপর ২০০৫ সালে ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেহেতু আগে থেকেই বন্ধুসভা করেছিলাম, তাই এখানেও বন্ধুসভার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছাটা প্রবল হয়ে উঠল। কিন্তু তখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুসভার কোনো কার্যক্রম ছিল না। ভাবলাম, যে করেই হোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুসভার কার্যক্রম শুরু করতে হবে। এভাবে ভাবতে ভাবতে একদিন প্রথম আলো অফিসে গেলাম। পরিচিত হলাম রওশন ভাইয়ের সঙ্গে। প্রথম দিনই ওনার সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেললাম। তিনি এ বিষয়ে অনেক কথা বললেন, কিন্তু কবে থেকে বন্ধুসভার কার্যক্রম শুরু করতে পারব, সে বিষয়ে কিছু বললেন না।

আমি হাল ছাড়িনি। এভাবে বেশ কিছুদিন যাওয়া-আসা করার মধ্য দিয়ে ২০০৬ সালে শুরু হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার কার্যক্রম। পার্থকে সভাপতি ও আমাকে সাধারণ সম্পাদক করে বেশ জোরেশোরেই আমাদের পথচলা শুরু হলো। এর মধ্যে মাহিম, রেওয়াজ, সোহাগ, আসাদ, শাকিলা, পৃথাসহ বেশ কিছু আলোকিত মুখ যুক্ত হলো আমাদের সঙ্গে। প্রতি বুধবার টিএসসির পূর্ব দিকের বারান্দায়, কখনো বা টিএসসির সবুজ ঘাসে বসতাম আমরা। সেখানে বিতর্ক, আবৃত্তি, পাঠচক্র, সিনেমা, গান–বাজনাসহ সবকিছুই থাকত। এমনকি ক্যারিয়ারবিষয়ক আলোচনাও হতো। ক্যাম্পাসে মাদক, ধূমপান, ইভ টিজিংবিরোধী ও বিভিন্ন সচেতনতামূলক বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান করে সবার কাছে প্রথম আলো বন্ধুসভাকে একটি ইতিবাচক সংগঠন হিসেবে ক্যাম্পাসে দাঁড় করিয়েছিলাম আমরা সবাই মিলে। ফলে অনেক ছেলেমেয়ে জড়ো হতে লাগলেন বন্ধুসভার ছাতার নিচে।

বন্ধুসভা নিঃসন্দেহে একটি মানবিক সংগঠন। তরুণ সমাজের মধ্যে মানবিক বোধ আর দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে বন্ধুসভা নিরন্তর কাজ করে চলেছে। বন্ধুসভার সদস্য হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখেছি, যেভাবে বন্ধুসভার সদস্যরা চরম বিপদ-আপদ আর দুর্যোগের সময় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন, মানবসেবার মহান ব্রত নিয়ে যেভাবে প্রতিনিয়ত কাজ করেন, তা সত্যি বিস্ময় জাগানিয়া।

তেজদীপ্ত তারুণ্যের ইতিবাচক বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর অন্যতম সেরা প্ল্যাটফর্ম হলো প্রথম আলো বন্ধুসভা। বন্ধুসভা আমার চোখে একটি বাতিঘরের মতো; যেখানে এসে আলোকিত করেছি নিজের সত্তা, বিকশিত করেছি সুকুমার বৃত্তিগুলো। সুপ্ত স্বপ্নগুলোর বাস্তবায়নে এবং বাস্তবতার নিরিখে ন্যায়-অন্যায় বুঝে পথ চলতে প্রেরণা জুগিয়েছে বন্ধুসভা। বন্ধুসভা নিঃসন্দেহে একটি মানবিক সংগঠন। তরুণ সমাজের মধ্যে মানবিক বোধ আর দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে বন্ধুসভা নিরন্তর কাজ করে চলেছে। বন্ধুসভার সদস্য হিসেবে খুব কাছ থেকে দেখেছি, যেভাবে বন্ধুসভার সদস্যরা চরম বিপদ-আপদ আর দুর্যোগের সময় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন, মানবসেবার মহান ব্রত নিয়ে যেভাবে প্রতিনিয়ত কাজ করেন, তা সত্যি বিস্ময় জাগানিয়া। একজন পুলিশ সদস্য হিসেবে বিভিন্ন জেলায় কাজ করেছি। নিজ চোখে দেখেছি সাধারণ মানুষ কত অসহায়। একটু আইনি সহায়তা, একটু সুন্দর ব্যবহার ও সহমর্মিতার আশ্বাস তাঁদের কতটা খুশি করতে পারে। আন্তরিকভাবে কোনো সমস্যার সমাধান করার পর তাঁদের চোখের কোণে যে আনন্দাশ্রু চিকচিক করে, তাতে বড্ড বেশি আপ্লুত হই। আরও বেশি প্রেরণা পাই। তাগিদ অনুভব করি ভালো কাজ করার, মানবিক দীক্ষায় দীক্ষিত হওয়ার। এই মানবিক বোধ, ভালো কাজ করার প্রেরণা, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা পরিবারের পরই পেয়েছি প্রিয় সংগঠন বন্ধুসভা থেকে। বন্ধুসভা আমাকে ভীষণ উজ্জীবিত করেছে, ভালো ও কল্যাণমূলক কাজ করার চিন্তার প্রয়াস পেয়েছি বন্ধুসভা থেকেই।

যা কিছু ভালো, তার সাথে প্রথম আলো। বন্ধুসভার সদস্য হিসেবে আমিও মনে-প্রাণে ধারণ করেছি, যা কিছু ভালো, সেখানেই আমি থাকব। খারাপ বা অন্যায় কোনো কিছুর সঙ্গে আপস করব না। এই শিক্ষা শক্তভাবে ধারণ করতে সাহায্য করেছে প্রথম আলো বন্ধুসভা।

বন্ধুসভা আমার বই পড়ার অভ্যাসটা গেঁথে দিয়েছে মনের গহিনে। বন্ধুসভার পাঠচক্র পর্বটি খুব উপভোগ করতাম আমি। উপন্যাস, গল্প, কবিতা ও সাহিত্যের যত বই পড়েছি, তা সম্ভব হয়েছে কেবল বন্ধুসভার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণেই। শুধু কি পড়া? কে কী পড়ল, কী ভালো লাগল বা মন্দ লাগল, সব আলোচনা হতো এই পাঠচক্রে। পাঠচক্রের আসরকে সাহিত্য সমালোচনার আসর বললেও ভুল হবে না।

সরস আর প্রাণবন্ত আড্ডার জায়গা ছিল বন্ধুসভা। বন্ধুসভার আড্ডাগুলোয় সাহিত্য, বিতর্ক, আবৃত্তি ছাড়া স্থান পেত সমসাময়িক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘটনা, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রবাহ-গতিপ্রবাহের নানা চালচিত্র। এসবের কারণে নিজেকে ধীরে ধীরে এমনভাবে সমৃদ্ধ করেছিলাম, যার ফল পেয়েছিলাম বিসিএসসহ চাকরির বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে।

পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে প্রায় প্রতিনিয়তই আমাকে বিভিন্ন সভা, সেমিনার কিংবা মিটিংয়ে কথা বলতে হয়, বক্তব্য দিতে হয়। আমি নির্দ্বিধায় এবং সাবলীলভাবে যতটুকু কথা বলতে পারি, তার শুরু হয়েছিল বন্ধুসভা থেকেই। আমরা প্রতি সপ্তাহে একেকজন একেক রকম বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতাম; হয়তো এ কারণেই আজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যেকোনো সভায় কথা বলতে পারি। শুধু তা-ই নয়, একজন পুলিশ কর্মকর্তার সাংগঠনিক সক্ষমতা থাকা খুব জরুরি। আমার সাংগঠনিক দক্ষতা মজবুত হয়েছে বন্ধুসভা থেকেই। বন্ধুসভায় থাকাকালীন বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সফল বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সাংগঠনিক ব্যাপারটি ভালোই রপ্ত করেছিলাম, যা বর্তমানে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে খুব কাজে দিচ্ছে। আজ ছাত্রজীবনের গণ্ডি পেরিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করলেও বন্ধুসভার প্রতি দরদ ও কৃতজ্ঞতা এতটুকু কমেনি। মনে-প্রাণে চাই, হাজারো ছেলেমেয়ে বন্ধুসভার ছায়ায় এসে নিজেরা আলোকিত হোক এবং সুন্দর এই দেশকে আলোকিত করে তুলুক। জয়তু বন্ধুসভা।

অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুসভা।

প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের প্রকাশনা ‘তারুণ্য’, সপ্তম সংখ্যা, আগস্ট ২০১৮ থেকে নেওয়া।