হাওর-বাঁওড়-মইষের শিং—এই তিনে মৈমনসিং

ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী আলেকজান্ডার ক্যাসেল। স্থানীয়ভাবে এটি লোহার কুটির নামে পরিচিতছবি: প্রথম আলো

ব্রিটিশ ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তর জেলা ছিল ময়মনসিংহ। মধ্যযুগে ‘মোমেনশাহ’ নামে মুসলিম সাধকের নামানুসারে মোমেনশাহী, ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার স্বাধীন সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ স্বীয় পুত্র সৈয়দ নাসিরুদ্দিন নসরত শাহের নামানুসারে ময়মনসিংহের নামকরণ হয় নাসিরাবাদ। পরবর্তী সময়ে একটি ভুলের কারণে নাসিরাবাদ নাম পরিবর্তন করে ‘ময়মনসিংহ’ রাখা হয়।

প্রাচীন বঙ্গের ময়মনসিংহ অঞ্চল বলতে বৃহত্তর ময়মনসিংহ তথা ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, টাঙ্গাইল, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ এবং সেই সঙ্গে গাজীপুর জেলাকে বোঝানো হতো। সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগের কথা। মধুপুর ভাওয়ালের বিশাল বনভূমির প্রান্তভাগে ছিল আসাম উপসাগর; যেখানে সুদূর হিমালয় থেকে নদীবাহিত পলি এসে ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে বৃহত্তর ময়মনসিংহের অপূর্ব ভূভাগ। ব্রহ্মপুত্রের আদি নাম তখন লৌহিত্য। পৌরাণিক মতে, ব্রহ্মা জনহিতার্থে পুত্রকে উৎসর্গ করায় নদের নাম হয় ব্রহ্মপুত্র। আঠারো শতকের প্রলয়কারী ভূমিকম্পে এর মূলধারা শাখা নদী যমুনায় প্রবাহিত হলে পলির প্রাবল্যে ক্ষীণ স্রোতায় পরিণত হয় আদি ব্রহ্মপুত্র, আজ এটা মৃতপ্রায়।

খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দ থেকে বঙ্গদেশের কোনো অস্তিত্বের কথা জানা যায় না, অনুসংহিতায়ও উল্লেখ নেই। রামায়ণ বঙ্গের বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এই সময় আর্যরা ভারতবর্ষে আগমন করে অনার্যদের বিতাড়িত করে। কালক্রমে নিগ্রোটোদ্রাবিড় রক্তমিশ্রিত অস্ট্রিক মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী আর্য প্রভাবকে স্বীকার করে বহিরাগতদের সঙ্গে মিলেমিশে ধর্মবোধ ও ভাষাগত ঐক্যের মাধ্যমে গড়ে তুলেছে ময়মনসিংহের অনন্য জনগোষ্ঠী। খ্রিষ্টীয় কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রসার লাভ এবং বৌদ্ধ রাজারা শাসনকর্তার ভূমিকা পালন করেন। আনুমানিক ৩০২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের নির্দেশে মেগাস্থিনিস ভারতবর্ষে আসেন। তাঁর রচিত ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থের মানচিত্রে তদানীন্তন ময়মনসিংহ অঞ্চল বিস্তৃত কামরূপ (আসাম) রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০ অব্দে সম্রাট অশোক মগধের সিংহাসনে আরোহণ করে ভারতবর্ষের প্রায় সমগ্র অঞ্চল শাসন করলেও বঙ্গদেশ দখল করতে পারেননি। চতুর্থ শতাব্দীর শেষ দিকে সমুদ্র গুপ্তের আমলে এতদঞ্চল মগধের অধীনে আসে।

৬২৯ থেকে ৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ভারত ভ্রমণরত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন-সাংয়ের বর্ণনা থেকে জানা যায়, পূর্ব ময়মনসিংহ তথা ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বাঞ্চল কামরূপের অধীনে আর পশ্চিমাঞ্চল পুণ্ড্রবর্ধনের অধীনে শাসিত হতো।

সপ্তম শতাব্দীতে হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব মলিন হয়ে যায়। ফলে মধ্য অষ্টম শতাব্দী থেকে নবম শতাব্দী পর্যন্ত পাল বংশ এবং পরবর্তী সময়ে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সেন বংশের রাজন্যবর্গ বঙ্গদেশ শাসন করেন। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলা দখল করে লক্ষ্মণাবতী তথা গৌড়ে রাজধানী স্থাপন করেন। পরে পূর্ববঙ্গে সালতানাত সম্প্রসারিত হলে সুবর্ণগ্রামে (সোনারগাঁ) রাজধানী স্থানান্তরিত হয় এবং সুলতানগণ স্বাধীন/দিল্লির অধীন থেকে শাসন কায়েম করেন। একসময় ঢাকা ছিল বঙ্গে মুসলিম শাসনের শেষ সীমানা। ১৪৯১ সালে দ্বিতীয় ফিরোজ শাহের আমলে সেন রাজবংশ শাসিত ময়মনসিংহের পশ্চিমাঞ্চল প্রথম মুসলিম শাসনাধীন প্রবেশ করে। ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্রের পূর্বাংশ যথারীতি কামরূপ রাজ্যের অধীনে থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে এর প্রভাব হ্রাস পেতে শুরু করলে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের সৃষ্টি হয় এবং গারো, কোচ প্রভৃতি রাজন্য দ্বারা শাসিত হয়। সুসঙ্গ পাহাড়িয়া অঞ্চলে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বৈশ্যা মান্দা নামক একজন গারো রাজত্ব করেন। সোমেশ্বর পাঠক নামীয় কান্যাজ্বু থেকে পূর্ববঙ্গে আগত পরাক্রান্ত জনৈক ভ্রমণকারী বৈশ্যা মান্দাকে সুকৌশলে পরাজিত করে সুসঙ্গের শাসন অধিকার করেন।

পাকুন্দিয়ার গঞ্জেরহাট নামক স্থানে ব্রহ্মপুত্রের ১১টি নদীর মোহনায় এগারো সিন্ধুর দুর্গ বেবুদ রাজার মাধ্যমে স্থাপিত হয় এবং ইতিহাসসমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে গড়ে ওঠে। সুলতানি আমলের পরই এগারো সিন্ধুর এলাকাটি কোচ হাজংদের অধিকারে চলে যায়। বাংলার বারো ভূঁইয়ার প্রধান ঈশা খাঁ তাঁকে পরাজিত করে দুর্গটি দখল করেন। এ দুর্গ থেকেই তিনি মোগল সেনাপতি রাজা দুর্জন সিংহ এবং ১৯৭৫ সালে রাজা মানসিংহকে নৌ ও মল্লযুদ্ধে পরাজিত করতে সমর্থ হন। পরবর্তী সময়ে সন্ধি স্থাপিত হলে মোগল সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজল তাঁকে ‘ভাটিরাজ’ উপাধি দেন। কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলা সদরের ১১ কিলোমিটার দূরত্বে দুর্গের ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান। ঈশা খাঁ ছিলেন আফগান পর্বতাঞ্চলের দলপতি সোলায়মান খাঁর সুযোগ পুত্র। পিতার সঙ্গে বঙ্গদেশে এসে তিনি আপন মেধা ও যোগ্যতায় বিশাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার মূল রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলা সদরের ৩ কিলোমিটার দূরত্বে জঙ্গলবাড়ী নামক স্থানে বিকল্প রাজধানীর স্থাপনাসমূহ পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্র।

সাবেক সভাপতি, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা